হযরত আইউব (আ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

হযরত আয়ুব (আ)-এর পরিচয়:

হযরত আয়ুব (আ) হযরত ইয়াকুব (আ) এর জ্যেষ্ঠভাই ইস বা আইস-এর বংশধর ছিলেন। ইসের পিতা ছিলেন হযরত ইসহাক (আ) এবং তিনি হযরত ইব্রাহীম (আ)-এর পুত্র ছিলেন।

অর্থঃ আয়ূব যখন তার প্রতিপালাক কে ডেকে বললেন, হে আমার পরওয়ার দেগার আমি কষ্টে পতিত হয়েছি। যে খোদা অপনার বেয়ে অধিক দয়ালু আর কটে নেই। আনন্তর আমি তাঁর দোয়া কবুল করলাম এবং তার দূর করে দিলাম। আব আম তাঁকে দান করলাম তাঁর পরিবার কাব্য ও তাদের-সসপরিমান আরো আমার পক্ষ থেকে রহমত স্বরূপ এবং আমার ইবাদতকারী বান্দাদের জন্য নদীহত।

(সুরা-আমিয়া-৮৩-৮৪)

হযরত ইউসুফ (আ)-এর পুত্র ফ্রাহীমের এক কন্যার নাম ছিল রাহীমা। হযরত আইয়ুব (আ)-এর রাহীমার সাথে বিবাহ হয়েছিল।

হযরত আইয়ুব (আ) একদিকে যেমন আল্লাহর নবী ও রাসূল ছিলেন, অন্যদিকে তিনি একটি বড় রাজ্যের বাদশাহও ছিলেন। তাঁর ধন-সম্পদ ও বিষয় বিভব ছিল ধারণাতীত। ঘোড়া, গরু, উট, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, মেষ, দুম্বা প্রভৃতির বড় বড় পাল ছিল হযরত আইয়ুব নবীর (আ)।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এ যে, এত ধন-দৌলত, বিষয়-বিভব এবং পশু-সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তাঁর মনে বিন্দুমাত্র অহঙ্কার ছিল না। অত্যন্ত ধর্মভীরু ছিলেন তিনি। দিবারাত্রি অধিকাংশ সময়ই তিনি আল্লাহর ইবাদাতে অতিবাহিত করতেন। তাঁর মেহমান নাওয়াজী বা অতিথি আপ্যায়নের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল যে, তিনি প্রত্যেক দিন যতক্ষণ পর্যন্ত না কোন অতিথিকে পানাহার করাতে পারতেন ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিজেও আহার করতেন না। হযরত ইব্রাহীম (আ) নবীর ধর্মীয় আদেশ এবং বিধি-বিধান তিনি প্রচার করতেন।


পাপীষ্ঠ ইবলীস তাঁর একনিষ্ঠ ইবাদাতে এবং ধর্মভীরুতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে একদিন আল্লাহর নিকট বলল, হে খোদা। তুমি তো হযরত আইয়ুব (আ)-এর প্রতি খুবই খুশী, কিন্তু ব্যাপারটা কি জান? সে যে তোমার এত আনুগত্য প্রদর্শন এবং তোমার এত ইবাদাত-বন্দেগী করে, পরোপকার প্রদর্শন করে, তার একমাত্র কারণ হল, তার প্রতি তোমার মুক্তহস্ত দান। আসলে তার ঈমান মোটেই তেমন মজবুত নয়। তুমি আমার কথা মত এসব ব্যাপারে একটু কমিয়ে দিয়ে পরীক্ষা করে দেখ, অমনি তার ভাওতা তোমার নিকট ধরা পড়ে যাবে।

আল্লাহ তায়ালা বললেন, হে ইবলীস। তুই ভুল ধারণা করেছিস। আমার বান্দা আইয়ুব সুখ-শান্তি ও প্রাচুর্যের মধ্যে থেকে আমার যেরূপ ইবাদাত করছে, আমি যদি তার নিকট হতে সবকিছু কেড়েও লই, তবে সে মহাকষ্ট-ক্লেশ ও দুঃখ-অশান্তির মধ্যেও একইরূপ ইবাদাত করবে, তুই আইয়ুবকে চিনতে পারিসনি। ইবলীস বলল, তা কিছুতেই নয়। তুমি যদি হযরত আইয়ুব (আ)-এর উপর আমাকে ক্ষমতা প্রদান কর, তবে আমি অচিরেই তার ঈমান কেড়ে নিয়ে তাকে বেঈমান করে দিতে পারব। আমি তোমার নিকট এ প্রতিজ্ঞা করছি।

আল্লাহ তায়ালা ইবলীসকে বললেন, আচ্ছা, তোকে আমি আইয়ুব (আ)-এর উপরে ক্ষমতা প্রদান করলাম, তুই যেভাবে পারিস চেষ্টা করে দেখ আইয়ুবের ঈমান নষ্ট করতে পারিস কিনা; কিন্তু আমি ভালভাবেই জানি, তুই আপ্রাণ চেষ্টা করেও তাঁর ঈমান নষ্ট করা ত ভাল, একটু দুর্বলও করতে পারবি না।

ইবলীস ক্ষান্ত হবার পাত্র নয়, সে তখনই হযরত আইয়ুব (আ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে দেখল যে, তিনি আল্লাহর এবাদতে মগ্ন আছেন। সে তাঁকে কিছু কুপরামর্শ দেয়ার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোন রকম সুযোগ না পেয়ে বিতৃষ্ণ মনে সেদিনকার মত চলে গেল।

কথিত আছে যে, আল্লাহ তায়ালার সাথে পাপীষ্ঠ ইবলীসের যে কথোপকথন হয়েছিল, তা ফেরেশতাগণও শুনতে পেয়েছে। তারা ইবলীসের কথাই সমর্থন করে বলেছে যে, হে মাবুদ। ইবলীসের কথা মিথ্যা নয়। আমাদেরও মনে হয় হযরত আইয়ুব (আ)-কে এত সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পদ দেয়ার কারণেই তিনি আপনার এত অনুগত ও ইবাদাতগুজার হয়েছেন। যদি তাঁর ও ধন-সম্পদ নিসে যাওয়া হয় কিংবা তাঁর সুখ-শান্তির বদলে দুঃখ-শোক ক্লেশ জড়িত করা হয়, তবে নিশ্চয়ই তাঁর এরূপ আনুগত্য ও ইবাদাত-বন্দেগী থাকবে না।

আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমি যা জানি তোমরা তার কিছুই জান না।

ফেরেশতাদের হযরত আইয়ুব (আ) সম্পর্কে এরূপ মন্তব্যের পর একদিন আল্লাহ তায়ালা হযরত আইয়ুব (আ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আইয়ুব। তোমাকে আমি যে সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পদ দান করেছি, তুমি কি তাই পছন্দ কর, না কি দুঃখ-মছিবত পছন্দ কর!


হযরত আইয়ুব (আ) জবাব দিলেন, হে মাবুদ। আপনি আমাকে যে সুখ-শান্তি আরাম আয়েশ ও ধন-সম্পদ দান করেছেন, এজন্য আমি আপনার সাধ্যমত শোকর করে থাকি। কিন্তু জানি যে, অভাব-অভিযোগ এবং দুঃখ-কষ্টে ধৈর্যাবলম্বন করার মূল্য অনেক বেশী। ধৈর্য রক্ষা করাকে আপনি অশেষ মর্যাদা দান করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমার তা নছীব হল না। আজ পর্যন্ত কোন একটি দিন আমি ধৈর্যাবলম্বন করার কোন সুযোগ পাইনি! এজন্য আপনার কাছে আমার আরজ এ যে, আপনি আমাকে দুঃখ, কষ্ট ও বিপদাপদ দিয়ে আমাকে ধৈর্যাবলম্বন করার তৌফিক ও সুযোগ দান করুন।


হযরত আইয়ুব (আ)-এর দোয়ার বদৌলতে বা ইবলীসকে প্রদত্ত অসীম ক্ষমতার প্রভাবেই হোক, কিছুদিনের মধ্যেই হযরত আইয়ুব (আ)-এর উপরে একটির পর একটি কঠিন বিপদ হতে লাগল।


একদিনের ঘটনা। যা উল্লিখিত ঘটনাগুলো হতে বেশী ভয়াবহ ছিল। হযরত আইয়ুব (আ)-এর চারটি পুত্র এবং তিনটি কন্যা বিদ্যালয়ে ছিল। বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাইরে কোন কাজে গেছেন। তিনি এসে দেখেন, বিদ্যালয় ঘরটি ভূমিস্মাৎ হয়ে হযরত আইয়ুব (আ)-এর সাতটি সন্তানই ছাদের নীচে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এ মর্মান্তিক ঘটনার কথা বিদ্যালয়ের শিক্ষক সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে হযরত আইয়ুব (আ)-কে শুনালেন।


হযরত আইয়ুব (আ) এ ঘটনা শুনে বললেন, আল্লাহর মর্জী যা ছিল, তাইতো হয়েছে। এতে আমার কোন হাত নেই। আর আল্লাহ তায়ালার নিজের বান্দার কখনও. কোন অমঙ্গল করেন না। আমার সন্তানগণ এভাবে মৃত্যুবরণ করে মহান শাহাদাতের দরজা পেয়েছে। এরূপ নছীব অর্জন করা শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর মর্জী ব্যতীত সম্ভব হয় না। অথচ আল্লাহ আমাকে এ মহা সৌভাগ্য দান করলেন। এজন্য আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শোকর জ্ঞাপন করছি।


এভাবে হযরত আইয়ুব (আ) এর প্রতি যতরকমের বিপদ এবং দুর্ঘটনা আসল, সর্বক্ষেত্রেই তিনি ধৈর্যের পরিচয় দিলেন এবং তাতে কল্যাণ নিহিত রয়েছে, এ কথার প্রতি বিশ্বাস রেখে প্রতিটি ক্ষেত্রেই আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করলেন।


ধন-সম্পদ, বিষয়-সম্পত্তি সবকিছুই তাঁর নিকট হতে চলে গেল। তখন স্বাভাবিকভাবেই তাঁর নিকট হতে কর্মকর্তা, সহচর, অনুচর, লোক লঙ্কার সকলেই একে একে বিদায় নিল। এমনি অবস্থায় তখন তাঁর সন্তানগণও মারা গেল, তখন তিনি এ পৃথিবীর বুকে সবকিছু হারা হয়ে একেবারে রিক্ত হয়ে গেলেন, কিন্তু সে সময় তিনি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি কোন রকম ক্ষোভ অভিমান কিংবা বিরক্তি প্রকাশ না করে আরও বেশী পরিমাণে আল্লাহর ইবাদাতে মগ্ন হলেন। তাঁর একান্ত অনুগত ও অনুরক্ত পত্নীগণ স্বামীর এ দুঃখজনক অবস্থায় এবং বিশেষভাবে স্তানদের লোমহর্ষকভাবে প্রাণ হারাবার ফলে বিষণ্ণ হয়ে পড়েন, কিন্তু তিনি আল্লাহর যে কোন মর্জীর উপরে ধৈর্যাবলম্বন এবং রাজী থাকার জন্য উপদেশ ও নছীহত করতে থাকেন।


ইতোমধ্যে তাঁর এ সমস্ত বিপদের মধ্যে আর একটি মহাবিপদ দেখা দিল। প্রথম তাঁর পদতলে একটি ক্ষুদ্র ফোস্কার মত দেখা গেল। দু'একদিনের মধ্যে তা ফেটে একটি ঘা-এর সৃষ্টি হল। তারপরই তার পুরো শরীরে ঘা হয়ে গেল। এ ছিল ভয়ঙ্কর কুষ্ঠ ব্যাধি। কয়েকদিনের মধ্যেই তার শরীরের চর্ম ও মাংসে পচন ধরে গেল। দুর্গন্ধ নির্গত হতে লাগল তাঁর শরীর হতে। এ অবস্থা দেখে তাঁর স্ত্রীগণের মধ্যে একমাত্র রহিমা ব্যতীত অন্য সকলেই তাঁকে ফেলে চলে গেল; কিন্তু বিবি রহিমা ছিলেন অদ্বিতীয়া পতিপ্রাণা সাধ্বী রমণী। তিনি যেমনই পরম ধার্মিকা রমণী ছিলেন, তেমনি স্বামী সেবাতেও সে যুগে সারা পৃথিবীর বুকে তাঁর তুলনা ছিল না।


হযরত আইয়ুব (আ)-এর এ চরম সঙ্কটকালে একে একে সবাই যখন তাঁকে বাদ দিয়ে চলে গেলেন, তখন একমাত্র বিবি রহিমাই তাঁর নিকট থেকে গেলেন এবং যথাসাধ্য তাঁর খেদমতে আত্মনিয়োগ করলেন। হযরত আইয়ুব (আ) তাঁকে বললেন, রহিমা। সবাই যখন চলে গেল, একা তুমি আর থাকলে কেন?


তিনি জবাব দিলেন, প্রিয় স্বামী! স্বাধ্বী নারীর জায়গা স্বামী ছাড়া কোথায় বলুন? একমাত্র স্বামীর যত্ন ও সেবাই তার কাম্য।


বিবি রাহিমার কথা শুনে হযরত আইয়ুব (আ)-এর মন এ চরমাবস্থার ভিতরেও আনন্দে ভরে গেল। তাঁর হৃদয় হতে একটি আশীর্বাদ ধ্বনি আপনা হতে উচ্চারিত হল: 'রাহিমা! আল্লাহ তোমার কল্যাণ করুন।' 

হযরত আইয়ুব (আ)-এর গলিত দেহ হতে তখন এমন বেশি দুর্গন্ধ বেরুতে লাগল যে, তাতে স্থানীয় বায়ু পর্যন্ত দুর্গন্ধময় হয়ে গেল। দেশের লোকজন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ার ভয়ে রাহীমাকে বলল যে, তুমি শীঘ্র একে নিয়ে নগরী পরিত্যাগ কর। একটি দিনের জন্য আমরা এখানে আর একে থাকতে দিব না। বাধ্য হয়ে তখন রাহিমা স্বামীকে তাঁর একটি চাটাই দ্বারা লেপটায়ে কাঁধে তুলে নিয়ে দূরবর্তী এক গ্রামে গিয়ে উপস্থিত হলেন। রোগাক্রান্ত হযরত আইয়ুব (আ)-এর দেহের ওজন তখন কমে এ পর্যায়ে পৌছল যে, তাকে বহন করে নিতে বিবি রাহিমার বেগ পেতে হল না।


কিন্তু স্বামীকে নিয়ে তিনি যে গ্রামে আশ্রয় নিলেন, সে গ্রামের লোকেরাও হযরত আইয়ুব (আ)-এর রোগ দেখে ও তাঁর শরীরের দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে তাঁকে তাড়িয়ে দিল। একইভাবে তিনি একে একে সাতটি গ্রামে গেলেন এবং সাতটি গ্রাম হতে বিতাড়িত হলেন।

হযরত আইউব (আ)-এর রোগমুক্তি ও পূর্বাবস্থা প্রাপ্তি

তাঁর গলিত দেহে অসংখ্য কীট সব সময় কিলবিল করত এবং দেহের গলিত মাংস ও রক্ত খেত। একদিন তাঁর শরীরের ঘা হতে হঠাৎ দুটি কীট মাটিতে পড়ে গেল। এ দেখে হযরত আইয়ুব (আ)-এর মনে অত্যন্ত দয়া হল যে, অসংখ্য কীট আল্লাহ তায়লার ইচ্ছাক্রমেই তাঁর দেহের মাংস খাচ্ছে, কিন্তু ঐ কাঁট দুটি বদ নছীব বলেই সম্ভবতঃ দেহ হতে ভূমিতে পড়েছে। অতএব তিনি কীট দুটির প্রতি দয়া ও সহৃদয়তাবশতঃ তাঁর দেহের যে স্থান হতে পড়েছে, নিজের হাতে ধরে তাদেরকে সেস্থানে বসিয়ে দিলেন।


কিন্তু কীট দুটিকে এভাবে বসিয়ে দেয়ার পর তারা শরীরে এমন মারাত্মকভাবে দংশন করতে লাগল যে, তিনি দীর্ঘ আঠার বছর পর্যন্ত তার এ কঠিন রোগে যে কষ্ট ভোগ করেছিলেন, এত বেশী কষ্ট কখনও ভোগ করেননি। সে কীটের দংশন জ্বালা সহ্য করতে না পেরে সেদিনই প্রথম তিনি আল্লাহর দরবারে কাঁদতে কাঁদতে ফরিয়াদ করলেন, 'হে মাবুদ! তুমি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ দয়ালু, আমি আর এ কষ্ট সহ্য করতে পারছি না, তুমি নিজের অফুরন্ত দয়াগুণে আমার এ অসহনীয় কষ্ট দূর ও রোগমুক্ত করে দাও।


অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, উল্লিখিত কীট দুটির প্রতি করুণা ও সহৃদয়তা বলে হযরত আইয়ুব (আ) তাদেরকে নিজের শরীরে বসিয়ে দিলেন আর তারপর হতে ঐ করুণার বিনিময়ে তাকে কষ্ট দিতে শুরু করে দিল, এর কারণ বা রহস্যটা কি ছিল?


এ প্রশ্নের জওয়াব হল, আল্লাহর মর্জীবশতঃই কীট দুটি শরীর হতে নিচে পড়েছে, কিন্তু হযরত আইয়ুব (আ) সে আল্লাহর মর্জীর প্রতি লক্ষ্য না করে তার বিপরীত কাজ করেছিলেন। এতে আল্লাহ তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হওয়ার ফলে তাঁর এরূপ কষ্টে ভুগতে হয়েছিল।


তবে সে যাই হোক না কেন, তাঁর সেদিনকার করুণ কান্না এবং রোগমুক্তির দোয়ায় করুণার আঁধার আল্লাহ তায়ালার কৃপা ও করুণারাশি তাঁর প্রতি বর্ষিত হল। হযরত আইয়ুব (আ)-এর ঈমান যাঁচাই ও তাঁর মাধ্যমে পাপীষ্ঠ ইবলীসের মিথ্যা দাবীর অসারতাও এতদিনে পুরাপুরিভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে এবার হযরত আইয়ুবের রোগমুক্তি এবং অন্যান্য বিপদ-আপদ মোচনের সময় আসন্ন হল।


অতঃপর একদিন নিত্যকার অভ্যাস মত বিবি রাহিমা স্বামীর জন্য খাদ্যের অন্বেষণে লোকালয়ে চলে গেলেন। এদিকে রুগ্ন হযরত আইয়ুব (আ) মহাগ্রতু আল্লাহর দরবারে কাঁদতে কাঁদতে অশ্রুধারায় যমিন ভিজাচ্ছিলেন। এমনি সময় ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) তাঁর নিকট হাজির হয়ে বললেন, হে আল্লাহর নবী। আল্লাহর দরবারে আপনার দোয়া মঞ্জুর হয়েছে। আপনি এখন উঠে বসুন।'


হযরত আইয়ুব (আ) বললেন, 'হে আল্লাহর দূত! আমি কেমন করে উঠে বসব বলুন। রাহিমার সাহায্য ব্যতীত আমি পার্শ্ব পরিবর্তনও করতে পারি না। আর আপনি কিনা আমাকে উঠে বসতে বলছেন। জিব্রাঈল (আ) বললেন, আপনি সাহস করে দাঁড়ান। আর যমিনের উপরে দুপায়ে সজোরে দুটি আঘাত করুন।


হযরত আইয়ুব (আ) তাঁর উপদেশ অনুসারে উঠে দাঁড়ালেন এবং যমিনের উপরে দু'পায়ে দুটি লাথি মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে পাশাপাশি দুটি ঝর্ণার সৃষ্টি হয়ে একটি হতে গরম পানি ও অন্যটি হতে শীতল পানি উৎসারিত হতে লাগল। তখন ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) তাঁকে আদেশ করলেন যে, গরম পানি দিয়ে আপনার পুরো শরীর উত্তমরূপে ধুয়ে ফেলুন এবং শীতল পানি পেট ভর্তি করে পান করে ফেলুন। জিব্রাঈল (আ)-এর উপদেশ অনুযায়ী উক্ত গরম পানির দ্বারা হযরত আইয়ুব (আ) সর্বাঙ্গ উত্তমরূপে ধৌত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে গেল। তাঁর শরীরে রোগের কোন চিহ্নমাত্র রইল না। এরপর তিনি উক্ত শীতল পানি পেট ভরে তৃপ্তি সহকারে পান করলেন। তাতে তাঁর ক্ষুধা-তৃষ্ণা একেবারে দূর হয়ে গেল। তিনি এবার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেন। তাঁর শরীরে যথেষ্ট শক্তি অনুভব করলেন। তাঁর দেহে দিব্যি স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য ফিরে আসল। এ সময় ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) বেহেশত হতে একখানা মনোরম চাদর নিয়ে আসলেন এবং তার হাতে অর্পণ করলেন। হযরত আইয়ুব (আ) চাদরখানা পরিধান করলেন।


এরপর তিনি ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) সহ নিকটস্থ একটি সেতুর নিকট গিয়ে বসে রইলেন। এখন তাঁর শরীর ও চেহারার এমন পরিবর্তন হয়েছে যে, যারা শুধু রুগ্ন আইয়ুব (আ)-কে দেখেছে তারা এখন এ আইয়ুব (আ)-কে দেখলে কোনক্রমেই বলতে পারবে না যে, এ সেই একই ব্যক্তি।


বিবি রাহিমা গেছেন গ্রামে ঝিয়ের কাজ করে স্বামীর জন্য কিছু খাবার সংগ্রহ করে আনতে। ইতোমধ্যে তিনি কিছু আটা, ডাল ও অন্যান্য দ্রব্য নিয়ে আসলেন। কিন্তু কুটিরে এসে তাঁর স্বামীকে দেখতে না পেয়ে তিনি একাধারে ভীতশঙ্কিত ও বিস্মিত হয়ে গেলেন এ কি ব্যাপার। কি হল তাঁর, যাঁর পক্ষে শায়িতাবস্থায় পার্শ্ব পরিবর্তন পর্যন্ত করা অসম্ভব, তিনি কোথায় যেতে পারেন? তার মনে অশুভ আশঙ্কা দেখা দিল। নিশ্চয় তাঁকে অরণ্যের বাঘ অথবা অন্য কোন হিংস্র জানোয়ার খেয়ে ফেলেছে কিংবা তুলে নিয়েছে। অথচ এ অলক্ষুণে ঘটনার কথা চিন্তাও করা যায় না। বিবি রাহিমা তখন পাগলিনী প্রায় হয়ে এদিকে সেদিকে ছুটাছুটি করে স্বামীর সন্ধান করতে লাগলেন। সেখানে কোন লোকজনও নেই যে, তাঁর স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করবেন। অবশেষে তিনি দৌড়াতে দৌড়াতে নিকটস্থ সেতুর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। দেখলেন, সেখানে দুটি লোক বসে কথাবার্তা বলছেন। তিনি তাঁদের কাছে বললেন, কাছেই একটি ক্ষুদ্র কুটিরে আমার রুগ্ন স্বামী শোয়া ছিলেন। তাঁর উঠে বসারও শক্তি ছিল না। আমি তাঁর জন্য কিছু খাবার সংগ্রহ করতে লোকালয়ে গিয়েছি; কিন্তু ফিরে এসে তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। আপনারা তাঁর কোন সন্ধান বলতে পারেন কি?


ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) বললেন, আপনি আপনার স্বামীকে দেখলে তাঁকে চিনতে পারবেন তো?

রাহিমা বললেন, কি বলেন, আমার স্বামীকে আমি চিনতে পারব না কেন? অবশ্যই আমি তাঁকে চিনতে পারব। তাঁর কথা শুনে জিব্রাঈল (আ)-এর পার্শ্বোপবিষ্ট হযরত আইয়ুব (আ) মুচকি হাসি প্রদান করলেন। রাহিমা সে হাসি দেখে কিছুক্ষণ তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব হল না। তিনি ছুটে গিয়ে হযরত আইয়ুব (আ)-এর গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললেন, প্রিয়তম! তবে দয়াময় আল্লাহ তায়ালা কি আপনার রোগ আরোগ্য করেছেন? এবার হযরত আইয়ুবও স্ত্রীর কণ্ঠালিঙ্গন করে কতক্ষণ ধরে কাঁদলেন।

কিছুক্ষণ উভয়ে এভাবে কেঁদে কেঁদে আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করার পর হযরত আইয়ুব (আ) বিবি রাহিমার অনুপস্থিতিতে যেভাবে যা ঘটেছে, তা বিবি রহিমার কাছে আনুপূর্বিক বর্ণনা করলেন।


এরপর স্বামী-স্ত্রী অরণ্যবাস বাদ দিয়ে রাজমহলে চলে গেলেন। গিয়ে দেখেন, আল্লাহ তায়ালার নিজের মেহেরবানীতে তাঁদের ধ্বংসপ্রাপ্ত সমস্ত বস্তুগুলো সাবেক অবস্থায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। হযরত আইয়ুব (আ)-এর পুরাতন ও জীর্ণ বাড়ীঘরগুলো নূতন রূপ ধারণ করে সুসজ্জিত রয়েছে। যে পুত্র-কন্যাগুলো মৃত্যুবরণ করেছিল তারা সবাই জীবিতাবস্থায় আমোদ-প্রমোদ করছে। যে সকল ধন-সম্পদ, মাল-সামান, পশুপাল ধ্বংপ্রাপ্ত হয়েছিল তা সবকিছুই এখন আবার ভরপুর দেখা যাচ্ছে।


হযরত আইয়ুব (আ)-এর যেসকল পাত্র-মিত্র, রাজকর্মচারী এবং সিপাহী-লঙ্কর তাঁর দুরবস্থার কালে তাঁকে ফেলে চলে গেছে, তারা একে একে সকলেই আবার তাঁর নিকট এসে জমায়েত হল। তিনি সবাইকে খুশী মনে গ্রহণ করলেন, কারও প্রতি তাঁর মনে এতটুকু ক্ষোভ বা অসন্তুষ্টি ছিল না।


আল্লাহ তায়ালার ঐরূপ অফুরন্ত দয়া ও অনুগ্রহের জন্য হযরত আইয়ুব (আ) ও বিবি রাহিমা আল্লাহর মহান দরবারে লাখ লাখ শোকর জ্ঞাপন করলেন। 

হযরত আইয়ুব (আ)-এর জন্মস্থান ও মৃত্যুর বিবরণ

হযরত আইয়ুব (আ)-এর জন্মস্থান সম্পর্কে বর্ণিত রয়েছে যে, শাম, দামেশক এবং রমশার মধ্যবর্তী স্থানে ছিনা নামক একটি বস্তিতে হযরত আইয়ুব (আ) জন্মগ্রহণ করেন; কিন্তু কোথায় বসে তাঁর মৃত্যু হয়েছে এবং কোন জায়গায় তিনি সমাধিস্থ হয়েছেন সে বিষয় কোথাও কোন বিশ্বস্ত বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এরূপ কথিত আছে যে, হযরত আইয়ুব (আ)-এর পদাঘাতে যে দুটি পানির নহর সৃষ্টি হয়েছিল ঐ নহর দুটি যথাস্থানে এখনও বিদ্যমান এবং দেশ বিদেশের বহু রুগ্ন লোক রোগ আরোগ্যের নিয়তে এখনও এসে ঐ কূপ দুটির পানি পান করে ও তার পানি দিয়ে গোসল করে শান্তি ও সুস্থতা অর্জন করে।


হযরত আইয়ুব (আ)-এর আয়ুষ্কাল সম্পর্কে কোন কিতাবে এরূপ বর্ণিত আছে যে, তিনি পৃথিবীতে সর্বমোট একশত চল্লিশ বছর জীবিত ছিলেন। তন্মধ্যে রোগাক্রান্ত ছিলেন মোট আঠার বছর। ঐ আঠার বছর ধরে তাঁর বয়স একশত বছর পূর্ণ হয়েছিল। রোগমুক্ত হবার পর তিনি পূর্ণোদ্যমে চল্লিশ বছরকাল দেশে ও দেশের চতুষ্পার্শ্বে ধর্ম প্রচার করেন। এর পর তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।


অন্য কিতাবে বর্ণিত আছে যে, হযরত আইয়ুব (আ) নবুয়ত লাভ করার পর মোট আটচল্লিশ বছর জীবিত ছিলেন। তন্মধ্যে আঠার বছর অতীত হয়েছিল তাঁর রুগ্নাবস্থায়। রোগ হতে আরোগ্য লাভ করে তিনি মোট ত্রিশ বছর ধর্ম প্রচার করেন।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url