হযরত উমরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা

হযরত উমর (রা)-এর প্রশাসনিক কাঠামোর বর্ণনা দিতে পারবেন। মজলিসে শূরার গঠন প্রক্রিয়া সম্বন্ধে বলতে পারবেন হযরত উমর (রা)-এর প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে লিখতে পারবেন।


ইসলামের ইতিহাসে হযরত উমর (রা) সুযোগ্য, উপযুক্ত একজন বিচক্ষণ ও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে সুখ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেন। তাঁর অনুসৃত প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আধুনিক শাসনের মূল কাঠামো। তিনি তাঁর প্রশাসনকে এরূপ একটি সুষ্ঠু, সুসংহতো, সুগঠিত ও সুদূর প্রসারী হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন যা বিশাল ইসলামি রাষ্ট্রের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করেছিল। রাসূলে করীম (স) ও হযরত আবু বকর (রা) ইসলামি শাসন ব্যবস্থা ও গণতন্ত্রের বীজ বপন করেন, হযরত উমর (রা) তাঁর পূর্ণরূপ দান করেন। হযরত উমরের (রা) খিলাফত হল রাসূল কর্তৃক বর্ণিত পদ্ধতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।


হযরত উমর (রা)-এর প্রশাসনিক ব্যবস্থা এত বেশী সুদৃঢ় ও শক্তিশালী ছিল যে, যার সাহায্যে তিনি একে একে বিভিন্ন দেশ, শহর ও শহরতলী দখল করেছিলেন। তাঁর আমলে ১০৩৬টি শহর বিজিত হয়েছিল।


হযরত উমর (রাঃ)-এর শাসন ব্যবস্থায় একনায়কত্বের কোন ছোঁয়া ছিল না তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে খলীফা মনোনয়ন করতেন। তিনি পরামর্শ সভার মতামত অনুযায়ী রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করতেন। তিনি সাম্য, ঐক্য ও ভাতৃত্বের বন্ধন দিয়ে জন কল্যাণকর প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। হযরত উমর (রা) এর প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে নিচে আলোচিত হল।


মজলিসে শূরা গঠন

হযরত উমর (রাঃ)-এর গণতান্ত্রিক শাসননীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রধান দিক ছিল মজলিসে শূরা বা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন। তিনি যে কোন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হলে আল-কুরআন ও আলহাদীসের ভিত্তিতে শুরার সাহায্যে তা সমাধান করতেন। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করতেন যে, পরামর্শ ছাড়া কোন খিলাফত চলতে পারে না। বস্তুতঃ তাঁর শাসনামলে পরামর্শ সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করে।


বস্তুত: তাঁর শাসনামলে শূরা গুরুত্বপূর্ণ রূপ লাভ করে। তাঁর শাসনামলে সাধারণ সভা দ-বার আহত হবার বিবরণ জানা যায়।


প্রথমত: কাদেসীয়ার যুদ্ধের পূর্বে তিনি স্বয়ং সৈন্য পরিচালনা করে যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করবেন কিনা সে বিষয়ে পরামর্শ করার জন্য তিনি সাধারণ সভা আহবান করবেন। উক্ত সভা খলীফাকে স্বয়ং সৈন্য পরিচালনা করার পক্ষে রায় প্রদান করেন। তিনি হয়ত আলীকে খিলাফতের ভার দিয়ে সেনা বাহিনীর সাথে গমন করেন। কিন্তু মদীনা থেকে তিন মাইল দূরে সিরার নামক জলাসয়ের নিকট আহল আল-রায় বা শূরার প্রতিনিধিদের আহবান করে উক্ত বিষয়ে তাঁদের পরামর্শ চান। আহল আল-রায় এবং অধিকাং সদস্য তাঁকে মদীনা অবস্থান করা এবং অন্য কোন সাহাবীকে সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করার পরামর্শ দেন। তিনি পুনরায় সাধারণ সভা আহবান করে সকলকে জানান যে, যারা সৎ পরামর্শ দেবে তাদেরকে মান্য করা কর্তব্য। তিন ঘোষণা করেন যে, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গমনের জন্য সকল ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরামর্শে প্রতিয়মান হচেছ যে, তাঁর রাজধানীতে অবস্থান করে কোন সাহাবীকে সেনা পতিত্ব প্রদান করা মঙ্গলজনক। কেননা স্বয়ং খলীফার পরাজয় হলে মুসলমানদের মনোবল ভেঙ্গে পড়তে পারে। বরং তিনি সৈন্য সংগ্রহ করে পরপর যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রেরণ করলে মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি পাবে। সকল লোক তাঁর যুক্তি অনুধাবন করেন। এবং সাদ ইবন আবী ওয়াককাসকে সেনাপতি হিসেবে ইরাকে প্রেরণ করে তিনি স্বয়ং মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন।


দ্বিতীয়বার। সিরিয়া ইরাক বিজয়ের পর উক্ত অঞ্চলের কৃষিভূমি সৈনিকদের মধ্যে বণ্টন করবেন, না উহা পূর্বের মালীকদের হাতে রাখবেন। এ বিষয়ে মীমাংসা করার জন্য তিনি দ্বিতীয়বার সভার বৈঠক আহবান করেন। খলীফা উমর ভূমির মূল মালিকদের বঞ্চিত করার বিপক্ষে ছিলেন। তিনি দুইটি কারণে পূর্বের মালিকদের মধ্যে ভূমি বণ্টনের পক্ষপাতী ছিলেন। প্রথমত। তিনি প্রশাসনিক কর্মচারী ও সৈনাবাহিনী নিয়মিত করার জন্য রাষ্ট্রের নিয়মিত আয়ের পক্ষপাতি ছিলেন। মুসলমানরে মধ্যে উক্ত সম্পত্তি বণ্টন করে দিলে রাষ্ট্র খারাজ হতে বঞ্চিত হবে।


দ্বিতীয়ত। প্রকৃত ভূমি মালিকদের বঞ্চিত করে আরবদের মধ্যে বণ্টন করার অর্থ তাদেরকে দৈন্যের মধ্যে ঠেলে দেয়। আর তা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক ছিল না। এ ব্যাপারে তাঁর আরো একটি মহান উদ্দেশ্য ছিল বলে জানা যায়। তিনি আরবদের বিশুদ্ধ সামরিক জাতি হিসেবে গড়ে তোলার পক্ষপাত ছিলেন। কৃষি ভূমি তাদের মধ্যে বণ্টন করলে তারা আরামপ্রিয় হয়ে পড়তো। তা নিঃসন্দেহে জাতির জন্য অমঙ্গল ও ক্ষতিজনক।


হযরত উমর (রাঃ) পরামর্শ সভার সদস্যদের সংখ্যাধিক্যের মতামতের উপর ভিত্তি করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন, এই মজলিসে শূরায় উল্লেখযোগ্য বড় বড় সাহাবীদের মধ্যে হযরত উসমান, আলী, আব্বাস, আবদুর রহমান ইবনে আওফ, হযরত মু'য়াজ ইবনে জাবাল, হযরত উবাই ইবনে কাব, হযরত যায়েদ ইবনে ছাবিত ও হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) সহ প্রমুখ সাহাবী সদস্য হিসেবে ছিলেন।


এ মজলিসে শূরা ছাড়াও আরও দু'টি মজলিস ছিল। যথা- মজলিসে আম (সাধারণ পরিষদ) ও মজলিসে খাস (বিশেষ পরিষদ)।


মজলিসে আম ও মজলিসে খাস 

মজলিসে-আম (সাধারণ পরিষদ) নবী করীম (সঃ)-এর ঘনিষ্ঠ ও বয়োজ্যেষ্ঠ সাহাবা এবং মুহাজির, আনসার, মদীনার বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ ও বেদুঈন দলপতিগণ নিয়ে গঠিত ছিল। আর মজলিসে খাস (বিশেষ পরিষদ) শুধু মুহাজিরদের নিয়ে গঠিত ছিল।


মজলিসে শূরার অধিবেশনের নিয়ম ছিল- আহবান কারী الصلاة جامعة )নামায প্রস্তুত) বলে ঘোষণা করতেন। জনসাধারণ মসজিদে নববীতে সমবেত হতেন। অতঃপর হযরত উমর (রাঃ) তথায় পৌছে সকলকে নিয়ে প্রথমে দু'রাকাত নফল নামায আদায় করতেন এবং মিম্বরে আরোহণ করে উদ্ভূত সমস্যার উপর বক্তৃতা করতেন। নমুনা হিসেবে তাঁর বক্তৃতার কয়েকটি বাক্য নীচে উদ্ধৃত করা হল-


"ইয়াতীমের ধন-সম্পতিতে তাঁর অভিভাবকের যে পর্যায়ের অধিকার রয়েছে তোমাদের সম্পদে তথা রাষ্ট্রীয় সম্পদে আমার অধিকারও সেই পর্যায়ের। আমি ধনী হয়ে থাকলে তা থেকে কিছুই গ্রহণ করবো না, আর যদি আমি অভাবী হয়ে থাকি তাহলে তা থেকে ন্যায় সঙ্গতভাবে গ্রহণ করবো। বন্ধুগণ। আমার উপর তোমাদের অসংখ্য অধিকার রয়েছে। আমার নিকট থেকে তোমাদের সেগুলো দাবি করা উচিত। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে: তোমাদের ভাতা বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয় হচ্ছে, তোমাদের সীমান্ত সংরক্ষণ করা, তৃতীয় হচ্ছে, তোমাদের বিপদের মধ্যে নিক্ষেপ না করা।"


উন্মুক্ত আলোচনার জন্য সকল বিষয়বস্তু সদস্যদের সম্মুখে পেশ করতেন। এমন কি প্রয়োজনে খলীফার সমালোচনারও সাধারণ অনুমতি ছিল। হযরত উমর (রাঃ) বলতেনঃ "পরামর্শ ছাড়া খিলাফত তথা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ সুষ্ঠুভাবে হতে পারে না।"


সাধারণতঃ মজলিসে শূরার পরামর্শক্রমে বড় বড় পদে লোক নিযুক্ত করা হতো। হযরত উমর (রাঃ) কোন এক জন যোগ্য আমানতদার, বিশ্বস্ত ও সত্যনিষ্ঠ লোকের নাম পেশ করতেন। যেহেতো হযরত উমরের মধ্যে মানুষ চেনার অন্ত ত বিচক্ষনতা ছিল। তাই মজলিসে শূরার সদস্যগণ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তাঁর নির্বাচনের প্রতি সমর্থন জানাতেন। এভাবে মজলিসে শূরার সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে লোক নির্বাচন ও সকল বিষয়ে ফয়সালা করতেন।


প্রশাসনিক কাঠামো

সাম্রাজ্য বিভাগ: হযরত উমর (রাঃ) ছিলেন ইসলামের রাজনৈতিক শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সময় ইসলামি সামরাজ্যের বিস্তৃতির ফলে গোটা ইসলামি সামরাজ্যকে মোট আটটি প্রদেশে বিভক্ত করেছিলেন। এ প্রদেশগুলো: মক্কা, মদীনা, সিরিয়া, জাযীরা, বসরা, কুফা, মিসর ও ফিলিস্তীন।


ঐতিহাসিক হোসাইনীর মতে হযরত উমরের সাম্রাজ্য ১৪টি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। মক্কা, মদীনা, সিরিয়া, জাযিরা, বসরা, কুফা, মিসর, ফিলিস্তীন, পারস্য, ইরান, কিরমান, খোরাসান, মাকরান, সিজিস্তান ও আজারবাইজান। ঐতিহাসিক শিবলী নোমানীর মতে প্রদেশের সংখ্যা ছিল ৪টি।


ওয়ালী, আমিল ও অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দ 

খলীফা উমর (রাঃ)-এর শাসন ব্যবস্থায় প্রদেশ ও জেলার শাসনকর্তাকে যথাক্রমে ওয়ালী বা আমিল বলা হতো। ওয়ালী শুধু প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য কর্মকর্তা যারা তাকে সাহায্য করতেন তারা ছিলেন কাতিৰ (সচিব) কাতিবউদ-দীওয়ান (প্রতিরক্ষা সচিব), সাহিবুল খারাজ (কালেক্টর), সাহিবুল এহদাস (পুলিশ-ইন্সপেক্টর জেনারেল), সাহিবু বায়তিলমাল (ট্রেজারার), কাজী এবং আরও অনেক কর্মকর্তা। পরবর্তী সময়ে হযরত উমর (রাঃ) অবশ্য রাজস্ব, বিচার ও সামরিক বিভাগকে প্রাদেশিক শাসনকর্তার এখতিয়ার থেকে পৃথক করে দেন।


ওয়ালী ও আমিলের দায়িত্ব

হযরত উমর (রাঃ)-এর প্রশাসনে প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের বিশেষ করে ওয়ালী এবং আমিলদের নিয়োগের পূর্বে তিনি তাদের নিজ নিজ দাযিত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা সম্পর্কে নিয়োগপত্রে অবহিতো করতেন। তারা যাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকালে কোন স্বৈরাচারী নীতি অনুসরণ না করেন তার জন্য তিনি জনসাধারণকেও তাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করতেন। দায়িত্ব পালনে কর্মচারীগণ কোন অবহেলা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি করলে তাদেরকে পদচ্যুত এবং ক্ষেত্র বিশেষ শাস্তিও প্রদান করা হতো।


হযরত উমর (রাঃ)-এর শাহাদাতের সময় নিম্নলিখিত ওয়ালীগণ (গর্ভণর) বিভিন্ন প্রদেশের দায়িত্বে ছিলেনঃ

১। মক্কার গভর্নর ছিলেন নাফে ইবনে আবুল হারেস খাযায়ী, ২। মিসরে আমর ইবনুল আস, ৩। তায়েফে সুফিয়ান ইবনে আবদুল হাক্কাফী, ৪। দামেস্কে মুয়াবিয়া, ৫। কুফায় মুগীরা ইবনে শো'বা, ৬। হিমসে উমায়ের ইবনে সা'দ, ৭। বসরায় আবু মুসা আল-আশআরী, ৮। বাহরাইনে উসমান ইবনে আবিল আ'স।


কর্মচারী নিয়োগ

হযরত উমর (রাঃ) গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে লোক নিয়োগ করার ক্ষেত্রে মজলিসে শূরার পরামর্শ নিতেন।


কর্মচারীদেরকে উপযুক্ত বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেয়া হতো। যাতে অবৈধভাবে অর্থোপার্জনের প্রতি কোন প্রকার লোভ স্বার্থ না হয়। কর্মচারী নিয়োগের পরও তাদের গতি বিধির উপর বিশেষ দৃষ্টি রাখতেন, যেন জনগণের উপর তারা অত্যাচার করতে না পারে। কর্মচারী নিয়োগের পর নিম্নলিখিত উপদেশাবলী দেয়া হতো। এমনকি কোন কোন সময় তা নিয়োগপত্রে উল্লেখ থাকত-


১। অতি মূল্যবান পোশাক-পরিচ্ছেদ পরতে পারবে না।


২। দামী বুটি বা খাবার খাবে না।


৩। বাড়ীর দরজায় কোন দারোয়ান রাখতে পারবে না, যাতে কোন সমস্যাগ্রস্ত লোক ইবনা বাধায় সংলিষ্ট


দায়িত্বশীলকে তাঁর বক্তব্য জানাতে পারে।


৪। অসুস্থকে দেখতে যাবে আর মৃত ব্যক্তির জানাযায় উপস্থিত হবে।


৫। কখনো উৎকৃষ্ট তুর্কী ঘোড়ায় আরোহণ করবে না।


উল্লেখিত উপদেশাবলী জনসাধারণের সম্মুখে পড়ে শুনানো হতো যাতে কোন ব্যতিক্রম দেখা দিলে তাঁরা খলীফাকে অবগত করতে পারে। সেই যুগে অনেকে রাষ্ট্রের সেবা করে বেতন নেয়াকে নৈতিকতার পরিপন্থী বলে মনে করতেন। হযরত উমর (রাঃ) এ ধারণার নিরসন করে, প্রত্যেক কর্মচারীর জন্য ভাতা নির্ধারণ করেন।


হযরত উমর (রাঃ) সকল কর্মচারীকে হজ্জের সময় মক্কাতে উপস্থিত থাকার নির্দেশ দিতেন। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রের প্রত্যেক এলাকা হতে অসংখ্য লোক মক্কায় সমবেত হতো। হযরত উমর (রাঃ) স্বয়ং সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলতেন। কোন কর্মচারীর বিরুদ্ধে সামান্য অভিযোগ থাকলেও আপনারা তা পেশ করতে পারেন।


কর্মচারীদের দুর্নীতিমুক্ত রাখার পদক্ষেপ

সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতিমুক্ত রাখার জন্য নিয়োগের পরই প্রত্যেককে তার স্থাবর-অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তির একটি তালিকা খলীফার নিকট পেশ করতে হতো। চাকরিকালে যদি কারও সম্পত্তি আয়ের অনুপাতে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেত, তাহলে অতিরিক্ত সম্পত্তি রাষ্ট্র কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হতো। কর্মচারীগণ যাতে কোনরূপ অসদুপায় অবলম্বন করতে না পারে তার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য হযরত উমর (রাঃ)-তাঁর দপ্তরে বিশেষ বিভাগ প্রবর্তন করেন। তিনি প্রত্যেক কর্মচারীর যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও মেধা অনুযায়ী তাঁর বেতন নির্ধারণ করতেন। প্রাদেশিক শাসনকর্তাকে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার দিরহাম পর্যন্ত ভাতা দেয়া হতো।


জেলা প্রশাসন 

হযরত উমর (রাঃ)-এর প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার অধীনে আমিল (জেলা প্রশাসক), কাযী (বিচারক) ও সাহিবে বায়তুলমাল (কোষাধ্যক্ষ) তাদের স্ব স্ব কার্য সম্পাদন ও কর্তব্য পালন করতেন। তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপিত হলে তার সত্যতা যাচাই করার জন্য নির্দিষ্ট কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। খলীফার নিকট তার পেশকৃত তথ্যাবলির ভিত্তিতে তিনি অভিযোগের যথাযথ প্রতিকার করতনে।


রাজস্ব বিভাগ

রাজস্ব বিভাগ প্রবর্তন হযরত উমরের অবিস্মরণীয় কীর্তি। কেননা এক্ষেত্রে তিনি এক বৈপস্তবিক পরিবর্তন সাধন করেন। রাসূলে করীমের সময় এবং হযরত আবু বকরের খিলাফত কালে রাজস্ব আদায়ের কোন সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সময়ে শুধু মুসলমানদেরকে উশর (উৎপন্ন ফসলের এক দশমাংশ) অথবা নিসফুল উশর (এক বিশমাংশ) প্রদান করতে হতো। জমির উপর এককালীন কিছু অর্থ আদায় ব্যতীত আবু বকরের (র) আমলে নির্দিষ্ট কোন কর ধার্য করা হয়নি। হযরত উমর (রাঃ) এর খিলাফত আমলে রাজস্ব আদায়ের জন্য স্বতন ও স্থায়ীভাবে লোক নিয়োগ করা হতো। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উপর সাধারণতঃ রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পন করা হতো না। আদায়কৃত রাজস্ব খলীফার নির্দেশ অনুসারে সৈনিকদের বেতন-ভাতা ও জনকল্যাণমূলক অন্যান্য সার্বজনীন কাজ-কর্মে ব্যয় করা হতো। উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় রাজধানীতে প্রেরণ করা হতো। তাঁর খিলাফত আমলে দু'প্রকারের রাজস্ব ধার্য করা হতো: (১) স্থায়ী ও (২) অস্থায়ী। স্থায়ী রাজস্বের মধ্যে যাকাত, উশর ও জিজিয়া উল্লেখযোগ্য। পক্ষান্তরে গণীমতের মাল ছিল অস্থায়ী রাজস্ব বা রাষ্ট্রীয় আয়।


বায়তুলমাল

বাইতুল মাল (কোষাগার)-এর প্রতিষ্ঠা ও পুনর্গঠন উমরের (রা) অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান। তাঁর খিলাফতের পূর্বে বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্ব থাকলেও একটি নিয়মিত ও সুসংগঠিত রাজস্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে কোন ভূমিকা ছিল না। খলীফা উমর ওয়ালিদ ইবন হিশামের পরামর্শে বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা এবং এটিকে একটি কার্যকরী জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। জনসাধারণের সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত বায়তুলমালে খলীফার কোন অধিকার ছিল না। তিনি ছিলেন এর রক্ষক মাত্র। বায়তুলমালে জমা করা অর্থ রাষ্ট্রের মুসলমান জনগণের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হতো।


১৮ হিজরীতে আরব ভূমিতে দূর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হযরত উমর (রাঃ) এ বিপর্যয় থেকে মানুষকে বাঁচাবার জন্য যে প্রচেষ্টা চালান তা ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ উদ্দেশ্যে তিনি বায়তুলমালের সমস্ নগদ অর্থ ও অন্যান্য সম্পদ ব্যয় করেন। সমস্ত প্রদেশ থেকে শস্য সংগ্রহ করেন এবং সুষ্ঠুভাবে দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকায় তা বিতরণ করেন। বেওয়ারিশ শিশুদের দুধ পান ও লালন-পালন করার ব্যবস্থা করেন। গরীব মিসকিনদের জন্য মাসোহারা নির্ধারণ করেন এবং মিম্বরে উঠে একথা ঘোষণা করেন:


"আমি প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য প্রতি মাসে (নির্দিষ্ট পরিমাণ) গম ও (নির্দিষ্ট পরিমাণ) সিরকা নির্ধারণ করছি। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল: কৃতদাসের জন্যও কি একই ব্যবস্থা? জবাব দিলেনঃ হ্যাঁ, কৃতদাসের জন্যও একই ব্যবস্থা, কিন্তু এভাবে সরকারী দান-খয়রাত খেতে খেতে মানুষ কুড়ে ও কর্ম বিমুখ হয়ে যাবে, একথা হযরত উমর জানতেন না ধারণা করা উচিত হবে না। আসলে তিনি, সমর বিভাগে কাজ করার অযোগ্য বা শারীরিক দূর্বলতার কারণে কাজ কর্ম করতে অক্ষম ব্যক্তিদেরই মাসোহারা নির্ধারণ করেন।"


বায়তুলমালের প্রধান কর্মচারীর উপাধি ছিল সাহিবু বায়তিলমাল। তিনি তার কাজের জন্য খলীফার নিকট দায়ী থাকতেন।


দিওয়ান প্রতিষ্ঠা

খলীফা উমর (রা) ভূমি রাজস্বের সুপরিকল্পিত পদ্ধতি প্রণয়নের জন্য দীওয়ান-উল-খারাজ (রাজস্ব বিভাগ) নামে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এই রাজস্ব বিভাগই সংক্ষেপে উমরের 'দিওয়ান' নামে পরিচিত। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ও খলীফা আবু বকরের শাসনকাল পর্যন্ত অর্থ দফতরকে বায়তুলমাল বলা হতো। উমর (রা) পারসিক কায়দায় এই দফতরের নাম রাখেন দিওয়ান। বৃহত্তর জনসমষ্টির মঙ্গল সাধন করা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বিবেচনা করে তিনি অর্থ বিভাগের পূনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। তাঁর সময়ে ইসলামি প্রজা তন্ত্রের ব্যাপক বিস্তৃতির ফলে রাজস্ব বিভাগ পরিচালনায় অনেক অসুবিধা দেখা দেয়। এসব অসুবিধা দূর করার জন্য তিনি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। জাতীয় অর্থের সুষ্ঠু বণ্টনের জন্য তিনি সর্ব প্রথম আদমশুমারির প্রচলন করেন। লোক গণনার মাধ্যমে প্রত্যেক রাষ্ট্রীয় ভাতা-ভোগীর নামের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। ইসলামের সেবায় নিয়োজিত প্রত্যেকটি আরব ও অনারব মুসলিম নারী-পুরুষ, শিশু, যুবক ও বৃদ্ধ সকলেই এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। অক্ষম, পঙ্গু, দুর্বল, রুগ্ন প্রভৃতি ব্যক্তিদের বায়তুলমাল থেকে বিশেষ ভাতা দেয়ার ব্যবস্থা ছিল। তিনি সকল মুসলিমকে বায়তুলমালের মালিক বলে ঘোষণা করেন। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অমুসলিমগণও এই ভাতা থেকে বঞ্চিত হতো না। ভাতা প্রদানের সুবিধার্থে মুসলিমদের তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়- ১ রাসূলের আত্মীয় পরিজন, ২. ইসলামের প্রাথমিক যুগের নিবেদিতপ্রাণ মুসলিম ও ইসলামের সাহায্যকারিগণ।


কৃষি উন্নয়ন

কৃষি উন্নয়নে হযরত উমর (রাঃ)-এর অবদান অতুলনীয়। তিনি খাল খনন করে পানি সেচের ব্যবস্থা করেন। ক্যালদিয়ায় তিনি খাল খননের ব্যবস্থা করেন। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের উপর বহু দিনের অবহেলিত বাঁধ নির্মাণ কাজের দায়িত্ব তিনি সুযোগ্য অফিসারদের হাতে ন্যস্ত করেন। মাকরিজির হিসেবে অনুযায়ী ১,২০,০০০ শ্রমিক সেচ কার্যে নিয়োজিত থাকত এবং তারা নিয়মিত বেতন পেত। হযরত উমর (রাঃ) অনাবাদী জমিগুলো চাষের আওতায় এনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যবস্থা করেন।


রাজস্বনীতি ও জমিদারী প্রথার উচ্ছেদঃ রাজ্য সম্প্রসারণের ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে খলীফা উমর (র) রাজস্ব ব্যবস্থার দিকে মনোনিবেশ করেন। তিনি বিজিত অঞ্চল মুসলমান সৈন্যদের মধ্যে জায়গীর হিসেবে বন্টনের ঘোর বিরোধী ছিলেন। কেননা, তাঁর মতে এই বন্টনে একদিকে যেমন কৃষিকাজের উন্নতি ব্যাহতো হতো, অন্যদিকে সৈনাদের শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা ইবনষ্ট হতো এবং তারা শক্তিহীন হয়ে পড়তো। তিনি প্রাচীন শোষণমূলক ভূস্বত্ব ও জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ সাধন করে স্থানীয় কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশার অবসান ঘটান।


উমর (রা) একবার প্রথম আদমশুমারি করে দেখলেন, প্রতি একজন মুসলিম সৈন্যের ভাগে তিনজন করে মাত্র বিজিতলোক পড়ে। তাই তিনি বিজিত এলাকার ভূমি ও জমিদারী স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে বন্টন করে রাজস্ব নির্ধারণ করে দেন। ফলে বিজিত এলাকা সকল সময়ের জন্য রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে থেকে গেল এবং উক্ত এলাকার পূর্বের স্বত্বাধিকারিগণ ভূমিহীন হওয়া থেকে রেহাই পায়। উমর (রা) বিজিত অঞ্চলে মুসলমানদের ভূ-সম্পত্তি ক্রয় নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি এ সব এলাকায় যে সব বিজয়ী মুসলিম ইতঃপূর্বে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিল তাদের জন্যও কৃষিকাজ বন্ধ ঘোষণা করেন। তাঁর এ ব্যবস্থার ফলে কৃষিকার্যের অভূতপূর্ব উন্নতি ও কৃষক সমাজের প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়


ভূমি জরিপ, বন্টন, বন্দোবস্ত, রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ঃ খলীফা উমর (রা) প্রথমে ইরাকের ভূমি জরিপ করে সুষ্ঠু বণ্টনের ব্যবস্থা করেন। জরিপ কার্য সম্পন্ন করার পর তিনি জমির বিলি-বন্দোবস্ত ও কর নির্ধারণ করেন। ভূমির উর্বরতার পার্থক্যের ওপর রাজস্বের হারের তারতম্য ঘটত। নগদ অর্থে বা উৎপন্ন ফসলের মাধ্যমে এককালীন কিংবা কিস্তিতে কর প্রদান করা যেত। এই কর কেবল বিজিত অঞ্চলের অমুসলিম কৃষকদের নিকট থেকে আদায় করা হতো। জরিপ কর্মচারীদের ত্রুটির জন্য অনেক জায়গায় কর নির্ধারণে কিছু গরমিল হতো। এরূপ ক্ষেত্রে জমির মালিকের প্রতি যাতে কোন অবিচার না হয় তার জন্য তাকে যথেষ্ট পরিমাণ জমি লাখেরাজ হিসেবে ছেড়ে দেওয়া হতো। ইরাকের ন্যায় সিরিয়া ও মিসরেও ভূমি রাজস্বের আমূল পরিবর্তন সাধন করা হয়। পারস্যে প্রাচীন রাজস্ব ব্যবস্থাই বহাল ছিল। চাষাবাদযোগ্য ইরাকী জমির আনুমানিক পরিমাণ ছিল ৩,৬০,০০,০০০ জরীব। এই জমি থেকে বাৎসরিক রাজস্ব আদায় হতো ৮.৬০,০০,০০০ দিরহাম। পরে অবশ্য রাজস্বের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়।


বিচার বিভাগ

ক্ষমতা পৃথকীকরণ ও কাযীর উপর বিচার ব্যবস্থা ন্যস্ত: বিচার ব্যবস্থার সংস্কার হযরত উমরের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। এই বিভাগের গঠন, প্রকৃতি ও উন্নতিতে তাঁর প্রশাসনিক মেধার সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। তিনিই সর্বপ্রথম বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। এযাবৎ ওয়ালী (প্রাদেশিক শাসনকর্তা) বিচার বিভাগের কার্যাবলী পরিচালনা করতেন। কিন্তু খলীফা উমর বিচার ব্যবস্থার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কাযীর ওপর ন্যাস্ত করেন। কাযী ওয়ালীর কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে বিচারকার্য সম্পন্ন করতেন। কুরআনের নির্দেশের আলোকে কার্যীকে বিচারের রায় প্রদান করতে হতো। কুরআনে সুস্পষ্ট কোন নির্দশ পাওয়া না গেলে হাদিস এবং হাদীসের পর ইজমা ও কিয়াসের উপর নির্ভর করতে হতো। বিখ্যাত কাযী শুরাইয়ার নিকট এক লিখিত পত্রে হযরত উমর (রাঃ) বলেছেন-


"He should follow the Quran Should that in the absence of elcar instructions in the holy book, he should seek guidance from the traditions of the prophet that lacking any precedence on any particular topic. he should have resort to the consensus of opinion (at lima) of the scholars (already expressed on various topics) and that lacking any guidance even in the yma he should depend on his own common serse


বিচারকের যোগ্যতা: ইসলামি আইন অনুযায়ী একজন কার্যীকে হতে হতো প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ, মুসলিম, স্বাধীন নাগরিক, চরিত্রবান, শ্রবণশীল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন, আইন বিশেষজ্ঞ, সম্ভ্রান্ত বংশীয় ও কুরআন এবং হাদীসের বৃৎষ্পত্তি সম্পন্ন।


বিচার বিভাগের স্বাধীনতাঃ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের দৃষ্টিতে সমতা বিধানই চিল হযরত উমর (রাঃ)-এর শাসন আমলের উল্লেখযোগ্য বিষয়। ধনি-দরীদ্র, রাজা-প্রজা, আত্মীয়-অনাত্মীয়, উঁচু-নিচু ছোট-বড় নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর জনসাধারণ যেন সমান বিচার ও মর্যাদা পায় এ ছিল বিচার বিভাগের লক্ষা। যে বিচারালয়ে সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য প্রকৃত সাম্যের ব্যবস্থা নেই, সেখানে সুবিচার আশা করা যায় না। এখানে বিচার হল প্রহসন মাত্র। হযরত উমর (রাঃ) অতি গুরুত্ব সহকারে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থা করেন। তিনি তাঁর এ সদিচ্ছা পূর্ণ হয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য অনেক সময় বাদী বা বিবাদী হয়ে বিচারালয়ে হাজির হতেন।


বিচারালয় প্রতিষ্ঠা: হযরত উমর (রা) ডাঁর সমগ্র সাম্রাজ্যে বিচারালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মজলিস-এ-শূরার পরামর্শক্রমে কার্যী য়োগ করেন। এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্যও তাদের ধর্মীয় আইন সম্মত বিচার পরিচালনার জন্য পর্যন্ত আদালতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।


বিচার সম্পর্কীয় মূলনীতি। হযরত উমর (রা)-এর বিচার সম্পর্কীয় যে মূলনীতির সন্ধান পাওয়া যায় তা নিম্নরূপঃ


১ কাষীকে বিচারক হিসেবে প্রত্যেক মানুষের সাথে সমান ব্যবহার করতে হবে।


২. সাধারণত সাক্ষ্য প্রমাণের দায়িত্ব বাদীর উপর।


৩. বিবাদীর যদি কোন প্রকার সাফাই না থাকে তাহলে তাকে শপথ করতে হবে।


৪ উভয় পক্ষ সর্বাবস্থায় আপোস নিষ্পত্তি করতে পারে। তবে আইনের বিরোধী কোন ব্যাপারে আপোস হতে পারবে না।


৫ মামলার রায় প্রদান করার পর বিচারক ইচ্ছা করলে এর পুন। বিবেচনা করতে পারবেন।


৬ মামলার শুনানীর জন্য নির্দিষ্ট একটি তারিখ থাকা প্রয়োজন। ৭. নির্দিষ্ট তারিখে যদি বিবাদী হাযির না হয় তবে মামলার রায় এক তরফা হয়ে যাবে।


৮. প্রত্যেক মুসলমানের সাক্ষ্যই গ্রহণযোগ্য তবে শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।


উল্লেখ্য যে, এ মূলনীতি সম্পর্কে জনৈক রোমান পন্ডিত বলেছেন, এ আইনগুলো পৃথিবীর দার্শনিকদের অমূল্য গবেষণা হতেও বহুগুণে শ্রেষ্ঠ।


কাষী উল কুযাত: প্রত্যেক প্রদেশে একজন প্রধান কাযী নিযুক্ত করা হয়েছিল। তাঁকে বলা হতো কাযী উল কুযাত। প্রত্যেক জেলাতেও একজন করে কার্যী নিযুক্ত করা হয়েছিল। কাযীগণ যেন দুর্নীতিপরায়ণ না হয় সে জন্য তাঁদেরকে উচ্চ হারে বেতন প্রদান করা হতো। বিচারের জন্য কোন ফি লাগত না এবং বিচারকার্য মসজিদে অনুষ্ঠিত হতো।


বিচারের ক্ষেত্রে সমতা বিধান: ন্যায় ও সুষ্ঠু বিচারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিচারের ক্ষেত্রে সমতা বিধান ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সকলকে সমান মর্যাদা দেয়া। বস্তুত যে বিচারালয়ে সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য প্রকৃত সাম্যের ব্যবস্থা নেই সেখানে সুবিচার না হয়ে বিচারের প্রহসন হয় মাত্র। হযরত উমর (রাঃ) অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি অনেক সময় ছদ্দবেশে বিচারালয়ে হাযির হতেন। তিনি সব সময় ন্যায় বিচারের পক্ষে ছিলেন। মদ্যপানের অপরাধে তাঁর পুত্রকে কঠোর শাস্তি প্রদান করতেও ছাড়েন নি। অর্থ অপব্যয়ের অভিযোগে তিনি সেনাপতি খালিদের বিচার করতেও দ্বিধাবোধ করেন নি। তিনি স্বয়ং মদীনার বাজারে ও রাস্তায় চাবুক হস্তে ঘুরে বেড়াতেন এবং কোন দুষ্কৃতিকারী ধরা পড়লে তাকে যথাস্থানেই শাস্তি প্রদান করতেন। "Omar's whip is more terrible than another's sword" পদাধিকার বলে কোন ব্যক্তি বিচারের রায় হতে মুক্ত হতে পারতো না। বসরা, কুফা, দামেস্ক, হিমসের জন্য বিশেষ বিচারক নিয়োগ করা হয়েছিল। অমুসলমানদের বিচার কাজ তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী পরিচালিত ছিল।


ফাতওয়া বিভাগ

আইনের একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, যদি কেউ অপরাধ করে কৈফিয়ত দেয় যে এটা অপরাধ বলে আমার জানা ছিল না। তবে এ কারণে তাকে কিছুতেই মুক্তি দেয়া যাবে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিককে একথা মেনে নিতে হবে যে, রাষ্ট্রের আইন-কানুন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান থাকতে হবে। কিন্তু আশ্চার্যের বিষয় অন্য কোন জাতিই এর ব্যবস্থা করেনি। বর্তমান ইউরোপসহ অনেক দেশই শিক্ষার সর্বোচ্চ মানে উপনীত হয়েছে। অথচ, সেখানেও জনসাধারণ অনেক আইন সম্পর্কে অজ্ঞ রয়ে গিয়েছে। ইসলামে এর একটি বিশেষ বিভাগ ছিল। এ বিভাগকে সাধারনত ফতওয়া বিভাগ বলা হয়ে থাকে। হযরত উমর (রা) এ বিভাগটি অত্যন্ত সুষ্ঠু ও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করেছেন তাঁর পূর্বাপর আর কোন যুগে এত উন্নত ব্যবস্থা দেখা যায়নি।


সামরিক বিভাগ

সামরিক বাহিনীকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্তিঃ খলীফা উমর (রা) মুসলিম জাতিকে একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীতে পরিণত করার প্রয়াস পান। সামরিক বাহিনীকে সুসংহতো করা এবং যুদ্ধের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকার জন্য তিনি একটি প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করেন। সামরিক শাসনের সুবিধার্থে ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে তিনি সমগ্র সাম্রাজ্যকে নয়টি সামরিক জেলায় (জুনদ) বিভক্ত করেন, যথাঃ মদিনা, কুফা, বসরা, ফুসতাত, মিসর, দামেস্ক, হিমস, প্যালেস্টাইন ও মসুল। জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য প্রত্যেকটি জুনদে ৪,০০০ অশ্বারোহী সৈন্যের একটি বাহিনী সলা তৈরি থাকত। সেনাপরিসের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে খলীফা সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতেন।


খলীফা সর্বাধিনায়কঃ ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পূর্ণাঙ্গ সৈন্য বাহিনী প্রবর্তন করেন খলীফা উমর (রা)। তাঁর সময়ে কেবল আরব মুসলমানগণের সেনাবাহিনীতে যোগদানের অধিকার ছিল। কাজেই সৈনিক বৃত্তি ছিল আরবদের আভিজাত্য। আর্থিক সঙ্গতি ও সামাজিক সম্মান লাভের অন্যতম উৎস। সেনা দফতরে সকল সৈন্যের নামে একটি ডালিকা রাখা হতো। সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন খলীফা নিজেই। প্রত্যেক বাহিনীর অবশ্য নিজস্ব অধিনায়ক ছিল। সৈন্যবাহিনীর নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা হতো। কর্তব্যে অবহেলা, বিশ্বাসঘাতকতা ও ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য তাদেরকে কঠোর শাস্তিভোগ করতে হতো।


সৈন্যবাহিনীর শ্রেণী বিভাগ: সৈন্যবাহিনীকে পদাতিক, অশ্বারোহী, তীরন্দাজ, বাহক, সেবক প্রভৃতি শ্রেণীতে বিভক্ত করা ছিল। রণক্ষেত্রে তারা অগ্র, মধ্য, পশ্চাৎ ও দুই বাহু হয়ে পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করত। প্রতি দশ জন্য সৈন্যের উপর একজন 'আমীর' প্রতি দশজন আমীরের ওপর একজন 'কায়েদ' এবং প্রতি দশজন কায়েদের ওপর একজন 'আমির' নিযুক্ত থাকত। 'আহরা' নামক বিভাগের মাধ্যমে সৈনাদের রসদ সরবরাহ করা হতো। যুদ্ধে সৈন্যরা তরবারি, বর্শা, বল্লম, তীর, ধনুক, ঢাল, বর্ম ও শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করত।


বেতন সৈন্যদের ভাতা : হযরত উমর (রাঃ) জায়গীরের পরিবর্তে সৈন্যদের নিয়মিত বেতন প্রদান করতেন। প্রত্যেক সৈন্যের প্রারম্ভিক বেতন ছিল প্রথম বছরে ২০০ এবং পরে ৩০০ দিরহাম। নিয়মিত বেতন ছাড়া সৈনিকগণ যুদ্ধলব্ধ সম্পদের অংশ ও উদ্বৃত্ত রাজস্বেরও অংশ লাভ করত। তাদেরকে ইবনামূল্যে খাদ্য ও পোশাক সরবরাহ করা হতো এবং তাদের পরিবার-পরিজন সরকারি কোষাগার থেকে ভাতা লাভ করত। সৈন্যগণ অসুস্থ হলে চিকিৎসার সরকারি সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত।


পুলিশ বিভাগ

শান্তিরক্ষা বাহিনীঃ খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম দিকে স্বতন্ত্র কোন পুলিশ বিভাগের কথা জানা যায় না। অনেক ঐতিহাসিকের মতে হযরত উমরই সর্বপ্রথম একটি সুসংগঠিত পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। দীওয়ান-উল-আদালত নামে একটি দপতর এই বাহিনীর কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করত। জনসাধারণের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা, অপরাধমূলক কাজ-কর্ম প্রতিরোধ এবং শান্তি ও নিরাপত্তা বিধান করাই ছিল পুলিশ বাহিনীর প্রধান কর্তব্য। তাছাড়া বাজারে ক্রয়-বিক্রয়ে সততা বজায় রাখা, ওজন পরীক্ষা ও অবৈধ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং মাদকদ্রব্য বিক্রয় ও প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা বন্ধ করাও এই বাহিনীর কাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পুলিশ বিভাগের প্রধানের নাম ছিল সাহিব-উল-আহদাস।


জেলখানা প্রতিষ্ঠা: জেলখানা প্রতিষ্ঠা হযরত উমরের অন্যতম কৃতিত্ব। মদীনার কেন্দ্রীয় জেলখানা ব্যতীত তিনি প্রত্যেক প্রাদেশিক রাজধানী ও জেলা সদরে একটি করে কয়েদখানা নির্মাণের আদেশ দান করেন। কেবল ফৌজদারী মামলার আসামীদের কারাদন্ড দেয়ার নিয়ম ছিল। অপরাধীকে শাস্তি স্বরূপ নির্বাসন দন্ড প্রদানও তাঁর সময় প্রবর্তিত হয়।


গোয়েন্দা বিভাগ

রাষ্ট্রের বিন্নি অবস্থা, কর্মচারীগণ কর্তৃক নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের যথাযথ পালন, রাষ্ট্রের মধ্যে কেউ না খেয়ে থাকে কিনা তার সঠিক খোঁজ খবর সংগ্রহ ইত্যাদি কাজের জন্য হযরত উমর (রা) বহু সংখ্যক গুপ্তচর ও পর্যবেক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। হযরত উমর (রাঃ) খোদ নিজেও মাঝে মাঝে গভীর রাতে মদীনার গলিতে বের হতেন এবং জনসাধারণের অবস্থা স্বচক্ষে পরিদর্শন করতেন। তাছাড়া জনসাধারণের জন্য হজ্জের সময় শাসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাধারণ অনুমতি ছিল।


দেশের অবস্থা অবগত হবার জন্য দেশের সর্বত্র সংবাদ সংগ্রহকারী ও রিপোটার নিয়োগ করেন। তাদের মাধ্যমে তিনি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংবাদগুলোও সংগ্রহ করতেন। ঐতিহাসিক তারাবী লিখেছেনঃ


"হযরত উমরের নিকট কোন কথা গোপন থাকতো না। ইরাকে যেসব বিদ্রোহ ঘটেছে এবং সিরিয়ায় যাদেরকে পুরষ্কৃত করা হয়েছে তাদের সবার খবর তাঁকে লিখে জানানো হতো"।


সংবাদ সরবারাহ প্রতিষ্ঠান এত বেশী তৎপর ছিল যে, মিসরের শাসনকর্তা নোমান ইবনে আদী বিলাসিতায় লিপ্ত হন।


হযরত উমর (রা) এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিলাসিভার খবর জানতে পেরে নোমানকে পদচ্যুত করে লেখেন, হ্যাঁ, তোমাদের একাজ আমার খারাপ লেগেছে।


তদন্ত বিভাগ

সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের ওদন্তের জন্য হযরত উমর (রা) একটি নতুন পদের সৃষ্টি করেন। মুহাম্মদ ইবনে আসলামা আনছারীকে এ পদে নিয়োগ করা হয়। কোন স্থান হতে কোন অভিযোগ আসলে খলীফা তৎক্ষণাৎ তাঁকে প্রেরণ করতেন। তিনি সরে জমিনে তা তদন্ত করতেন এবং স্থানীয় লোকজনের সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ করে খলীফার নিকট বিবরণী পেশ করতেন। কর্মচারীদের চরিত্রের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতেন। ইনসাফ ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাই ছিল এ পদ সৃষ্টির অন্যতম লক্ষ্য।


গৃহ নির্মাণ ও পূর্তবিভাগ

ইসলামি রাষ্ট্রের পরিধি যতই বিশাল আকার ধারণ করতে থাকে, বিভিন্ন আবাসিক ঘর-বাড়ি নির্মাণের কাজ ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। হযরত উমর (রা)-এর শাসনামলে একার্য সম্পাদনের জন্য স্বতন্ত্র কোন বিভাগ ছিল না। তা সত্ত্বেও প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের দায়িত্বে একাজ সুষ্ঠুরূপে অগ্রসর হতে থাকে। প্রতিটি স্থানে অফিসারদের বসবাসের জন্য সরকারী আবাসিক এলাকা ও জনগণের সুযোগ-সুবিধার জন্য পুল, সড়ক ও মসজিদ নির্মিত হয়। পথিক ও প্রবাসীদের আশ্রয় নেয়ার জন্য মুসাফিরখানা তৈরি করা হয়। অনুরূপভাবে সামরিক প্রয়োজনে দুর্গ, ক্যাম্প ও ব্যারাকসমূহ নির্মাণ করা হয় এবং রাজকোষের হেফাজতের জন্য বায়তুলমাল বা খাজাঞ্চীখানার ইমারত তৈরি করা হয়। রাষ্ট্রীয় কর্মকা েহযরত উমর (রা)-এর ব্যয়-সংকোচন নীতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তা সত্ত্বেও বায়তুলমালের প্রাসাদ সাধারণতঃ বেশী মজবুত ও জাঁক-জমকভাবে তৈরি করা হয়।


মক্কা ও মদীনার মধ্যে বিশেষ সম্পর্কের কারণে উভয় শহরের যোগাযোগ ও যাতায়াত ব্যবস্থা অত্যন্ত সুগম ও শান্তিপূর্ণ হওয়া আবশ্যক ছিল। তিনি মক্কা হতে মদীনা পর্যন্ত দীর্ঘ পথের পাশে অনেকগুলো পুলিশী পাহারা, সরাইখানা ও ঝর্ণাধারা নির্মাণ করেন।


কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন ও উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধির জন্য খলীফা সমগ্র দেশে কূপ বা খাল খনন করেন এবং সেচকার্য সম্পাদনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করেন। বসরায় মিষ্টি পানি সরবরাহের উদ্দেশ্যে নদী হতে খাল খনন করা হয়। এ খালের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় নয় মাইল। এ প্রসঙ্গে নহরে মা'কাল, নহরে মায়াদ ও নহরে আমীরুল মু'মিনীন এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি হিজরী সনের প্রবর্তন ও মদীনার মসজীদের সংস্কার ও সম্প্রসারণ করেন। পবিত্র কাবা গৃহও তার সময় পুনঃ নির্মাণ করা হয়।


শহর নির্মাণ

আরবের মরুভূমি হতে বিশ্ব বিজয়ী শক্তি হিসেবে মুসলমানগণ যখন বহির্বিশ্বে পদার্পণ করেন। তখন অন্যান্য দেশের সবুজ-শ্যামল ও মনোরম দৃশ্য তাদেরকে মুগ্ধ করে। ইসলামি আদর্শ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলামি রাষ্ট্রের পক্ষ হতে বিভিন্ন সরকারী কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে তারা রাজধানী মদীনা হতে বহু দূর দূরাঞ্চলে বসবাস করতে বাধ্য হয়। এর ফলে তাদের দ্বারা প্রতিবেশী দেশগুলো বিভন্ন শহর ও নগর গড়ে ওঠে। হযরত উমর (রা)-এর খিলাফত কানে বসরা, কৃষ্ণা, ফুস্তাত মূসেল প্রভৃতি ইতিহাস বিখ্যাত নগর স্থাপিত হয়। বসরা শহরে প্রথমে মাত্র আটশত লোক বসবাস শুরু করে। পরে অল্প দিনের মধ্যে অধিবাসীদের সংখ্যা প্রায় এক লাখ বিশ হাজার পর্যন্ত পৌঁছে। ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে এ শহর শতাব্দীকাল পর্যন্ত মুসলমানদের গৌরবের বস্তু হয়ে থাকবে।


ইরাকের জনৈক আরব শাসনকর্তা রাজধানী পুনঃনির্মাণ করায় কুফা নগরের সৃষ্টি হয়। এ শহরে চল্লিশ হাজার লোকের বাসোপযোগী গৃহাদি নির্মাণ করা হয়। হযরত উমর (রাঃ)-এর নির্দেশক্রমে এর সড়কসমূহ চল্লিশ হাত প্রশস্ত করা হয়। এখানে যে জামে মসজিদ নির্মিত হয়, তাতে একসঙ্গে চল্লিশ হাজার মুসলমান নামায আদায় করতে পারত। জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসেবে এ শহরের ঐতিহাসিক মর্যাদা সর্বজন বিদিত।


ফুস্তাত শহর নির্মাণের ইতিহাস অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। মিসর বিজয়ী হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) নীল নদ ও মালতাস পর্বতের মধ্যবর্তী স্থানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেন। এ সময় ঘটনাবশত একটি কবুতর তাঁর তাবুতে নীড় রচনা করে। হযরত আমর (রাঃ) যখন এস্থান ত্যাগ করে যেতে ছিলেন। তখন এ অতিথির শান্ত নীড়ে কোনরূপ ব্যাঘাত যেন সৃষ্টি না হয় সে চিন্তায় তিনি তাঁবুটিকে যথাযথভাবে দাঁড় করে রাখলেন। উত্তর কালে এই তাঁবুকে কেন্দ্র করেই ফুস্তাত শহর গড়ে উঠে। চতুর্থ শতাব্দীর জনৈক পর্যটক এ শহর সর্ম্পকে লিখেছেন এ শহর বাগদাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পাশ্চাত্যের কেন্দ্র ও ইসলামের গৌরব। এখানকার মসজিদ অপেক্ষা মুসলিম জাহানের আর কোন মসজিদে জ্ঞান বিজ্ঞানের এত আলোচনা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় নি।


মুসেল শহর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন স্থলে অবস্থিত। এ দৃষ্টিতেই সম্পূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশে নির্মিত এ শহরের নামকরণ হয়েছে। অজ পাড়াগাঁকে বিরাট শহরে পরিণত করার এটি একটি বাস্তব নিদর্শন। হযরত উমর (রা)-এর নির্দেশে এখানে একটি বিশাল জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। আলেকজান্দ্রিয়া বিজয়ের পর হযরত আমর ইবনুল আস (রাঃ) সমুদ্রোপকূলে কিছু সংখ্যক সৈন্য চেয়েছেন। কেননা সমুদ্র পথে রোমান শত্রুদের আক্রমণের ভয় ছিল। উত্তর কালে এখানে একটি বিরাট উপনিবেশ গড়ে ওঠেছিল।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url