মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের সচিবালয়

মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের সচিবালয়সমূহ সম্পর্কে বলতে পারবেন,ৎমদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ সম্পর্কে লিখতে পারবেন, মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত গোড়াপত্তন সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন, মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরু সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।

মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব

এক দশকের কম সময়ের মধ্যে মহানবী (স)-এর প্রতিষ্ঠিত মদীনা রাষ্ট্র এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয় যাকে মুসলমানদের জাতীয় রাষ্ট্র বলা যায়। পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে ইসলামি রাষ্ট্রের পরিচালক নবী মুহাম্মদ (স) ছিলেন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্তৃত্বের একমাত্র উৎস। আইন, প্রশাসনিক, সামরিক ও বিচার বিভাগীয় সকল ক্ষমতা তাঁর হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। একটা সরকার ও প্রশাসনযন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে বেশ কিছু সংখ্যক সাহাবীকে বিভিন্ন পদে নিয়োগ করে তাঁদের নিকট তিনি স্বীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। তাঁর এ প্রশাসন যন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক বা বিভাগীয় এবং স্থানীয় প্রশাসকগণ। কেন্দ্রীয় প্রশাসক হিসেবে ছিলেন স্বয়ং নবী (স) তাঁর সকল প্রতিনিধি, উপদেষ্টা (মুশীর), সচিব (কাতিব), দূত (রাসূল), কমিশনার কবি (শুয়ারা) ও বক্তা (খুতাবা) এবং আরও নানা ধরনের কর্মকর্তাগণ। অপরপক্ষে প্রাদেশিক কর্মকর্তারা ছিলেন বিভিন্ন গভর্নর (ওয়ালী), স্থানীয় প্রশাসকবৃন্দ (রুআসা), স্থানীয় প্রতিনিধিবর্গ (নকীব), বিচারকবৃন্দ (কুজাত) ও বাজার কর্মকর্তা (সাহিবুস-সৃ'ক) গণ এদের সকলকে নিয়ে নবী করীম (স)-এর এক দশকের শাসনামলের প্রশাসনের বিভিন্ন শাখা ও কর্মকর্তাদের নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন।

প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুবিধার্থে তিনি তাঁর প্রশাসনকে বিভিন্ন বিভাগে বিভক্ত করে নিয়েছিলেন। বর্তমানে ঐ বিভাগগুলোর প্রতিটি এক একটি সবিচালয় হিসেবে গণ্য করা যায়। মহানবীর প্রতিষ্ঠিত বিভাগ ও সচিবালয়সমূহ নিম্নরূপ ছিল।

স্বরাষ্ট্র বিভাগ

রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারসমূহের ব্যাপারে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম পূর্ণ সাম্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেন। এ ব্যাপারে তিনি ভাষা, গোত্র ও শ্রেণীর ভেদ করতেন না, সাদা কালোর পার্থক্য করতেন না অর্থাৎ দেশের যে কোন নাগরিক চাই মুসলিম হোক, বা অমুসলিম উচ্চ বংশের হোক বা নিম্ন বংশের। সুন্দর হোক কি কুৎসিৎ, ধনী হোক কি দরিদ্র সকল নাগরিককে বিনা পার্থক্যে কোরআনের অনুসৃত মৌলিক অধিকার প্রদান করতেন। জানমাল ইজ্জত সম্মান ও নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা, নারী-পুরুষ, ক্রীতদাস ও নিম্নশ্রেণীর নাগরিকদের সার্বিক নিরাপত্তা, প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীদের আকিদা, বিশ্বাস ও ধর্মীয় স্বাধীনতা, এতীম অভাবী ছিন্নমূল ও অক্ষম লোকদের সরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রতিপালন প্রভৃতি ছিল মহানবী (স)-এর স্বরাষ্ট্র বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।

ইসলামি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু অমুসলিমকে চাপ প্রয়োগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার কোন বিধান ছিল না, বরং তারা যদি ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আনুগত্য স্বীকার করে নিত তবে তাদেরকে রাষ্ট্রের মৌলিক অধিকার ও সুযোগ সুবিধা পরিপূর্ণভাবে প্রদান করা হতো। তবে তাদেরকে রাষ্ট্রের যাবতীয় আইন কানুন মেনে নিতে হতো এবং রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি ও সমৃদ্ধিতে জানমাল সহ অংশ গ্রহণ করতে হতো। এ সম্পর্কে কয়েকটি মূল নীতি নির্ধারু করা হয়েছিল-

• তারা ইসলামি রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করবে।

• দেশের আইন মেনে চলবে এবং কোন প্রকার বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্খলা ও দেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোন কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোন ভাবেই অংশ গ্রহণ করতে পারবে না বা কেউ এসব কাজে লিপ্ত হলে তাকেও কোন প্রকার সাহায্য বা সমর্থন দিতে পারবে না।

• দেশের সকল উন্নয়নমূলক কাজে সাহায্য করতে হবে।

• রাসূল (স)-এর স্বরাষ্ট্র নীতি ছিল দেশের সকল শ্রেণী ও মৈত্রীর সংগে মিলেমিশে বসবাস করা। আর কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি দেখা দিলে সকলে মিলে-মিশে শৃঙ্খল ফিরিয়ে আনা।

বিচার বিভাগ

সুবিচার প্রতিষ্ঠাকে একটি রাষ্ট্রের মেরুদন্ড বলা যেতে পারে। ইসলাম স্বভাবগত ধর্ম হওয়ার কারণে সুবিচারের প্রতি সর্বাধিক গরুত্ব প্রদান করে। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স) সুবিচারের প্রতি যে গুরুত্ব আরোপ করেছেন ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। ধনী-দরিদ্র, মুসলিম-অমুসিলম, বন্ধু-শত্রু সকলের জন্য তাঁর ইনসাফ ও সুবিচার ছিল সমান। তিনি কোন ব্যক্তির অপরাধ সম্পর্কে পূর্ণ নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে শাস্তি প্রদান করতেন না। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (স) তাঁর জীবদ্দশায় নিজেই ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবং প্রাদেশিক ও স্থানীয়ভাবে বিচারপতিদের নিয়োগ তিনি নিজেই করতেন। হযরত মুহাম্মদ (স) বিভিন্ন এলাকা ও বিভিন্ন সময়ের জন্য যেসব বিচারপতি নিয়োগ করেন তাদের মধ্যে হযরত আবু বকর (রা), হযরত ওমর (রা), হযরত উসমান (রা), হযরত আলী (রা), হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ, হযরত উবাই বিন কাব, ও হযরত মুআয ইবন জাবাল (রা) প্রমুখ সাহাবীর নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। (বিচার বিভাগ সম্পর্কে অত্র ইউনিটের ৫ নং পাঠে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।)

অর্থ বিভাগ

বিশ্বের সর্বপ্রথম ইসলামি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হযরত রাসূলে করীম (স) একদিকে নাগরিকদের নৈতিক মান উন্নীত করেছেন অন্যদিকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে পবিত্র রাখার সুব্যবস্থা করেছেন। তার পাশাপাশি তিনি জনগণের অর্থনৈতিক বৈষম্যও দূরীভূত করার বিধান প্রবর্তন করেছেন যাতে মানুষের মৌলিক প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হয়। একথা সর্বজনবিদিত যে, ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে মানুষের জীবনের সকল সমস্যার সমাধান স্বরূপ।

এ পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র জীবন-বিধান, যা তার মৌলিক আকিদা ও বিশ্বাসের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিধি বিধানকেও যথা যোগ্য স্থান দিয়েছেন। ইসলাম মানুষের প্রয়োজন ও দুঃখ-কষ্ট লাঘবকে ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামি বিধান প্রবর্তনের মাধ্যমে শুধু যে, দারিদ্র পীড়িত মানুষের দুঃখ কষ্ট লাঘবের ব্যবস্থা করেছে তাই নয় বরং ধনীদের সম্পদকে পবিত্র করার একটি বাস্তব ব্যবস্থাও করেছে। রাষ্ট্র ও নাগরিকের ব্যয় মেটানোর জন্য।

রাসূলুল্লাহ (স) রাষ্ট্রীয় উপার্জনের প্রধান খাত হিসেবে পাঁচটি খাতকে নির্বাচিত করেছিল। খাতগুলো হলঃ গনিমত, ফাই, যাকাত, জিযিয়া ও খারাজ।

শিক্ষা বিভাগ

দেশ পরিচালনা ও প্রশাসনের জন্য শিক্ষা অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ বিষয়। হযরত মুহাম্মদ (স) শিক্ষার প্রসারের জন্য সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতেন। প্রখ্যাত সাহাবীদেরকে এ দায়িত্বে নিয়োজিত করে রাখা হয়েছিল। অনেককে শিক্ষার প্রধানতম উৎস ওহী লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল।

তদানীন্তন আরব ভূমিতে শিক্ষা-দীক্ষার তেমন প্রচলন ছিল না। শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য, কিন্তু হযরত রাসূলুল্লাহ (স) শিক্ষালাভ ও জ্ঞান অর্জনকে জেহাদ তুল্য ঘোষণা করেন। প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরয" করে দেন। তিনি জ্ঞানের মাহাত্ম্য সম্পর্কে বলেন, "শিক্ষা নবীশদের সম্মানার্থে ফেরেশতারা তাদের ডানা বিছিয়ে দেন।" একবার তিনি বলেন, "জ্ঞানী ব্যক্তির মর্যাদা ইবাদতকারী ব্যক্তির চেয়ে ততটুকু উপরে, যতটুকু আমার মর্যাদা তোমাদের (সাহাবীদের) একজন সাধারু ব্যক্তির উপরে।” তিনি পবিত্র মক্কায় 'দারুল আরকাম' কে প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রহণ করেন। বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে যে সকল মুশরিক বন্দী হয় তাদের মধ্যে অনেকের মুক্তিপণ ছিল দশ ব্যক্তিকে স্বাক্ষর জ্ঞানদান।

রাসূলে করীম (স) শিক্ষার প্রতি কত গুরুত্ব দিয়েছিলেন এ ঘটনা থেকে তা অনুভব করা যায়। মদীনা মোনাওয়ারায় শিক্ষা ও স্বাক্ষর জ্ঞানের জন্য হযরত সাইদ বিন আ'স (রা)-কে নিয়োগ করা হয়েছিল।মসজিদে নববীর নির্মাণ সুসম্পন্ন হওয়ার পর সেখানে হযরত রাসূলুল্লাহ (স) একটি শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। নিঃস্ব ও আশ্রয়হীন সাহাবাগণ ঐ শিক্ষাকেন্দ্রে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ স.-এর নিকট জ্ঞান অর্জন করত। স্থানীয় ছাত্র ব্যতীত দূর দূরান্ত থেকেও অনেক এসে ঐ শিক্ষা কেন্দ্রে শিক্ষা লাভ করতেন। বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন গোত্রের অনুরোধক্রমে রাসূলুল্লাহ (স) মদীনা মোনাওয়ারা থেকে শিক্ষক প্রেরু করতেন। রাসূলুল্লাহ (স) ওহী লেখক হযরত যায়েদ বিন ছাবেতকে ইব্রানী ভাষা শিক্ষার নির্দেশ দিয়েছিলেন। হযরত যায়েদ (রা) নিজে বলেছেন: আমি অল্প কয়েকদিনেই এ ভাষা শিক্ষা লাভ করি। মহানবী (স) তাঁর বিভিন্ন বাণীতে শিক্ষাদান পদ্ধতি কি হওয়া উচিৎ তা উল্লেখ করেন। ইমাম বুখারী মহানবী (স)-এর এসব বাণীকে গবেষণা করে শিক্ষা-পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর সংকলিত গ্রন্থ বুখারী শরীফে বর্ণনা করেছেন। 
শিক্ষাক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (স)-এর প্রচেষ্টার ফলশ্রুতিতে অল্প দিনের মধ্যেই মুসলিম জাতি তদানীন্তন বিশ্বের শিক্ষকরূপে পরুিত হয়।

কৃষি বিভাগ

আরব ভূমির অধিকাংশ এলাকাই বালুকাময় মরুভূমি ছিল। মহান নবী (স) মানুষকে বহু অনাবাদী জমি চাষাবাদের জন্য দান করেন এবং অধিক ফসল ফলনোর জন্য তাদেরকে উৎসাহ প্রদান করেন।

বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, হযরত আবু হোরায়রা (রা) বলেন- হযরত রসূলে করীম (স) এরশাদ করেছেন- যার নিকট চাষাবাদ যোগ্য জমি থাকবে তার অবশ্যই তাতে চাষাবাদ করা উচিৎ অন্যাথায় অন্যকে চাষাবাদের জন্য প্রদান করা উচিত।" অর্থাৎ আবাদযোগ্য জমি যেন অনাবাদি না থাকে।

বৃক্ষরোপন সম্পর্কেও মহানবী (স) অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সাহাবায়ে কেরামকে উৎসাহ প্রদান করতেন। হযরত আনাস (রা) বলেন, রাসূল (স) এরশাদ করেন- কোন মুসলমান যদি বৃক্ষ রোপন করে অথবা কোন চাষ করে তবে ঐ বৃক্ষের ফল, উৎপাদিত শস্য মানুষ, পশুপাখি অথবা অন্য জীবজন্তু খায় তাহলে বৃক্ষ রোপনকারী দান করার প্রতিদান পাবে।

অধিক শস্য ফলানোর জন্য হযরত রাসূলে করীম (স) সেচ ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। সাহাবায়ে কেরামকে এজন্য পারস্পরিক সহযোগিতা করার উপদেশ দান করেন। জমি চাষের ক্ষেত্রে বর্গা অথবা ইজারা নীতি কি হবে তা তিনি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন। মুসলিম শরীফে এ সম্পর্কে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে।

দাওয়াত ও ধর্ম প্রচার বিভাগ

একটি দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নতির জন্য সে জাতিকে সঠিক পথে পরিচালনা করা যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনিভাবে সর্বদা জাতিকে সত্যের দিকে আহবান ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। মহান আল্লাহ বলেন-

"তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মাত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে; তোমরা সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে।" (সূরা আলে-ইমরান: ১১০) রাসূল (স) বলেন-

"তোমাদের মধ্যে যারা উপস্থিত হয়েছ তারা অনুপস্থিত লোকদের নিকট আমার বাণী পৌছে দিবে।" (বুখারী)

এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য রাসূলুল্লাহ স প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও অত্যন্ত সুযোগ্য একটি দল তৈরী করেছিলেন। তারা বিভিন্ন এলাকায় দ্বীন ইসলামের তাবলীগ ও কুরআনে পাকের শিক্ষাদান কাজে রত থাকতেন। মসজিদের ইমামও রাসূলুল্লাহ (স) সরকারী ভাবেই নিয়োগ করতেন। তাঁরা স্ব-স্ব মসজিদে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করতেন। এছাড়া মহানবী (স) বিভিন্ন এলাকায় দায়ী প্রেরু করতেন।

পরামর্শ বিভাগ

মজলিসে শূরা
কোন কাজ সম্পাদনের পূর্বে সে কাজের বিশেষজ্ঞ ও পারদর্শী ব্যক্তিদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করার উপর ইসলাম সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। স্বয়ং আল্লাহ তা'আলাও পরামর্শের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। কুরআন পাকের একটি সূরার নামকরুও করেছেন "শূরা" (পরামর্শ) শব্দ দ্বারা। আল্লাহ পাক এ সম্পর্কে বলেছেন-

"তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে।" (সূরা আশ-শূরা ৩৮) 
সূরা আল-ইমরানে আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স)-কে সম্বোধন করে বলেছেন-

"এবং কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর।" (সূরা-আল-ইমরান-১৫৯)


তাই, রাসুলুল্লাহ (স) তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সম্পাদনের পূর্বে সাহাবীদের সঙ্গে পরামর্শ করা অনিবার্য আদর্শরূপে গ্রহণ করেছিলেন। বদর, উহুদ, খন্দকের যুদ্ধসহ হোদায়বিয়ার সন্ধি ইত্যাদি ঘটনায় সিদ্ধান্ত নেয়া সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (স) সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করেন।

রাসূলুল্লাহ (স) যদিও ওহী দ্বারা সরাসরি নির্ভুল জ্ঞান লাভ করতেন এবং ঐ জ্ঞানের আলোকে তাঁর কার্যাবলী পরিপূর্ণ নির্ভুলভাবে সম্পাদিত হত, আর এজন্য তিনি অন্যের কোন পরামর্শ গ্রহণের মুখাপেক্ষী ছিলেন না, তবুও বিষয়টির গুরুত্বের কারণে তিনিই সর্বাধিক পরামর্শ করতেন। উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশ (রা.) বলেনঃ "আমি রাসূলুল্লাহ (স)-এর চেয়ে অধিক পরামর্শ করতে অন্য কাউকেও দেখিনি।"

পররাষ্ট্র বিভাগ

পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারেও রাসূলুল্লাহ (স) অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। এজন্য তিনি যে সমস্ত নীতি গ্রহণ করেছিলেন তার উল্লেখযোগ্য বিষয় সমূহের মধ্যে ছিল-

• আরব দেশের সীমান্তগুলোকে বাইরের আক্রমণের আশংকা থেকে নিরাপদ করা।

• ইয়ামান, আম্মান, বাহরাইন ও ইরানী দখলদারদের থেকে মুক্ত করা।

• সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী এলাকা দোমাতুল জনদল এবং অন্যান্য এলাকা হতে রোমনদের কর্তৃত্ব তুলে দেয়া।

• পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহ- আবিসিনিয়া, ইরান ও মিশরের রাষ্ট্রনায়কদের নিকট পত্রযোগে ইসলামের দাওয়াত দেয়া এবং সংগে সংগে তাদেরকে ইসলাম গ্রহণ করার অনুরোধ করা।

• শত্রু কখনো আক্রমণ করতে চাইলে তাদেরকে ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্তে প্রবেশ করার সুযোগ না দিয়ে সীমান্তেই তাদের মোকাবেলা করা। তবুকের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (স) এ নীতি গ্রহণ করেছিলেন।

• রাষ্ট্রদূতদের প্রাণের নিরাপত্তা বিধান ইসলামি পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কেউ এর লঙ্ঘন করলে রাসূলুল্লাহ (স) তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতেন।

হযরত হারেস (রা) নামক একজন দূতকে বসরার গভর্ণর হত্যা করায় প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স) তার প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য ৩ হাজার সৈন্য প্রেরু করেন। আর মুতার যুদ্ধ এজন্যই সংঘটিত হয়। পারস্য সম্রাট তাঁর প্রেরিত চিঠি ছিড়ে ফেললে এবং দূতকে অপমান করলে তাকে অভিশম্পাৎ করেন। কোন গোত্রের সঙ্গে চুক্তি হলে তিনি তা পুরোপুরি রক্ষা করতেন যতক্ষণ না প্রতিপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করত, কুরআনের বাণী 

'তারা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে, তবে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে।' (সুরা আল-আনফাল : ৬১)

সমাজকল্যাণ বিভাগ

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (স) ইতিহাসের প্রথম কল্যাণ রাষ্ট্র কায়েম করেছিলেন। এমনি রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য কল্যাণবাদী সমাজ ব্যবস্থার অস্তিত্ব পূর্বশর্ত। যে সমাজে প্রতিটি ব্যক্তি ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়, পরস্পর পরস্পরের কল্যাণ কামনা করে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে তা অন্যের জন্যেও পছন্দ করে। একে অন্যের দুঃখ নিবারণে সমভাবে সচেষ্ট হয়। বিশ্ব মানবের সার্বিক কল্যাণ সাধনে সকলেই অগ্রগামী হতে সচেষ্ট হয়। প্রিয়নবী রাসূলুল্লাহ (স) এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেছিলেন যা, পৃথিবীতে অদ্বিতীয়, অনন্য সাধারু, সকলের জন্য অনুসক্রীয় এবং সর্বত্র প্রশংসনীয়। যে সমাজের প্রতিটি ব্যক্তি যাবতীয় নৈতিক গুণে গুণান্বিত, ধৈর্য ও সহনশীলতা, পরস্পরের সহযোগিতা, সহমর্মিতা, আর্তের প্রতি দয়া, অনাথ, বিপদগ্রস্ত মানুষের সেবা প্রত্যেকেরই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, এমনি একটি সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করতে গিয়েই মাহনবী (স) বলেছেন-

"পৃথিবীতে যারা বসবাস করে তাদের দয়া প্রদর্শন কর, তাহলে ঊর্ধ্বে অবস্থিত মহান আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াবান হবেন।"

তিনি আরও বলেছেন তোমরা মোমিনদেরকে পরস্পরে মধ্যে দয়ামায়ায় এবং সহমর্মিতায় একটি দেহের মত পাবে। দেহের একটি অংশে ব্যাথা পেলে তা সর্বাংশে অনুভূত হয়। এরকম অগণিত বাণী হাদীস গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

সামরিক বিভাগ

কোন স্বাধীন দেশের নিরাপত্তা ও শক্তি সে দেশের সামরিক বাহিনীর শক্তির উপর নির্ভরশীল। এজন্য সামরিক বাহিনীকে অনেক সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয়।

কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (স) যে সামরিক বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তারা কোন সরকারের বাহিনী ছিল না। বরং তারা সকলেই ছিলেন আল্লাহর সৈনিক। তাদের জন্য কোন বেতন ভাতা ধার্য ছিল না। তারা গণিমতের সম্পদের আশায়ও লড়াই করতেন না। তাদের লড়াই, জীবন-মরু সবই ছিল এক আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য। সামরিক বাহিনীতে তাদের ভর্তির প্রয়োজন হত না, যখনই জেহাদের ডাক আসতো তখনই পরুিত বয়সের প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানই তাতে অংশ গ্রহণ করে আত্মোৎসর্গ করার জন্য নিজেকে পেশ করতেন।

আল্লাহ পাকের সৈনিকদেরকে শুধু মাত্র তখনই অস্ত্র পরিচালনার অনুমতি প্রদান করা হত যখন মুসলিম জাতি অথবা দেশকে ধ্বংস করার জন্য শত্রু আক্রমণ করত অথবা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করত। এছাড়া দুষ্কর্ম, বিশৃঙ্খলা ও ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদ্রোহ দমনের জন্য এবং জুলুম নিপীড়ন ও দুর্বল ও মজলুমদের সাহায্যার্থে লড়াই-এর অনুমতি ছিল।

রাসূলুল্লাহ (স)-এর জীবদ্দশায় সংঘটিত বড় বড় যুদ্ধগুলো তিনি নিজেই পরিচালনা করেছেন, আর ছোট ছোট যুদ্ধে কোন বিশিষ্ট সাহাবীকে সেনাপতি নিযুক্ত করে তা পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করছেন। মুসলিম বাহিনীর সামরিক কলা-কৌশল শিক্ষাদান ছাড়াও তাদের নৈতিক ও চারিত্রিক তরবিয়তের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হত। তাই রাসূলুল্লাহ (স) সৈনিকদের সামান্য ত্রুটির জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। হযরত রাসূলে করীম (স) যুদ্ধের পূর্বে সৈন্যদের অত্যন্ত গুরুত্ব সহ সতর্ক করে দিতেন যে, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যেন বৃদ্ধ, শিশু, মহিলা, ধর্মগুরু ও কৃতদাসদেরকে হত্যা করা না হয়। মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে, "কোন যুদ্ধে প্রেরণের পূর্বে প্রিয়নবী (স) বৃদ্ধ, শিশু ও মহিলাদেরকে হত্যা না করার জন্য বিশেষভাবে তাকিদ করছেন।" (মহানবী (স)-এর সামরিক বিভাগ সম্পর্কে (অত্র ইউনিটের ৬নং পাঠে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।)

কাতিব (সচিববৃন্দ)

মহানবী (স) তাঁর বিভিন্ন লিখন কর্ম সম্পাদন করার জন্য অনেক সচিব নিয়োগ করেছিলেন। সচিবের আরবি প্রতি শব্দ "কাতিব"। কাতিব শব্দের শাব্দিক অর্থ লেখক। কিন্তু কালের বিবর্তনে শব্দটি একট পরিভাষায় রূপ নিয়েছে যার অর্থ দাড়ায় সচিব। প্রাক-ইসলামি যুগেই শব্দটি উক্ত পারিভাষিক তাৎপর্য লাভ করেছিল। এটি "কিতাবাহ" (লিখন কলা) থেকে উৎসারিত। যারা লিখতে পারতেন তাদেরকে কাতিব বলা হত এবং সে কারণেই তাদেরকে উচ্চ সম্মান দেয়া হত। ইসলামের আবির্ভাবের পর লিখন শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হল। মক্কায় অবস্থান কালে নবী (স) ওহী লিপিবদ্ধ করণের এবং রাজনৈতিক দলিল রচনার জন্য কয়েক ব্যক্তিকে নিয়োগ করেছিলেন। এক বর্ণনা মতে নবী (স).-এর মক্কী জীবনের প্রথম দিকে শূরাহবীল নামে একজন কাতির ছিলেন। রাসূল (স)-এর মক্কা অবস্থানকালে আরও যাঁরা লেখকের দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরা হচ্ছেন: আব্দুল্লাহ ইবন সা'দ, সা'দ ইবন আবী সারহ, আবু বকর, উমর, উসমান এবং আলী (রা) সহ আরও কিছু সংখ্যক সাহাবী।

মদীনায় ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর কাতিবদের কাজটি ধর্মীয় প্রকৃতি ছাড়াও রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। এর গোড়াপত্তন করেছেন স্বয়ং নবী (স)। তবে সে সময়ে এ বিভাগটি এ নামে পরিচিত ছিল না। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে তিনি তাঁর সামরিক কর্মকর্তা, গভর্ণর ও প্রশাসকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও নির্দেশ অবহিত করার জন্য পত্র বিনিময় করতেন এবং কর্মকর্তারাও তাঁর নিকট পত্র লিখতেন। অনুরূপ ভাবে তিনি বিভিন্ন শাসক ও যুবরাজদের নিকটও বেশ কিছু পত্র প্রেরু করেছিলেন এবং অনেক দূতকে স্বীয় পত্রসহ আরব ও অনারব নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের নিকট পাঠিয়েছিলেন। এছাড়া বেশ কিছু ব্যক্তি ও গোত্রের নিকট নবী (স) কর্তৃক নিরাপত্তা প্রদানের জন্য পত্র প্রেরিত হয়েছিল। সবশেষে বলতে হয়, বহুব্যক্তির নিকট তিনি পত্র পাঠিয়েছেন। এসব দলিল পত্রের বিষয়াদি এমন এক বিভাগ কর্তৃক আনযাম দেয়া হত যেটা পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ একটি দিওয়ান-ই-ইনশাহ বা নথি-পত্র বিভাগে উন্নীত হয়েছে এবং স্বাভাবিক ভাবেই এক্ষেত্রে লেখক ও করণিকদের সেবাদানের প্রয়োজন হয়েছে।

সচিবদের সংখ্যা

বিভিন্ন সময়ে যারা নবী (স)-এর পক্ষে লেখকের দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা কত এ ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মত পার্থক্য রয়েছে। ইবন ইসহাক ও ইবন হিশাম তাঁদের মাত্র কয়েক জনের নাম উল্লেখ করেন। অপর পক্ষে ঐতিহসিক ওয়াকিদী বেশ কিছু কাতিবের নাম বর্ণনা করেন। প্রাথমিক স্তরের লেখকদের মধ্যে ইবন সাদের বর্ণনামতে নবী (স)-এর দলিল-পত্রের কাতিবদের সংখ্যা দাড়ায় ১৬জন। অথচ বালাযূরী ও তাবারী মাত্র দশজনের নাম উল্লেখ করেন। বস্তুত এটা পরবর্তী গ্রন্থকারদের কৃতিত্ব যে, নবী (স) কর্তৃক নিযুক্ত কাতিবদের একটি পূর্ণ নাম- তালিকা সংকলন করতে গিয়ে তাঁরা সর্বাধিক সংখ্যক নাম পেশ করার এক সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়েছেন। তারা ২৩ ও ২৫ জন কাতিবের দু'টি তালিকা পেশ করেছেন। সে সবের অধিকাংশ ইবন সাদ এর পুস্তকেও উল্লিখিত হয়েছে। তবে আল-কুরতুবীর তাফসীরে ২৬টি নাম লক্ষ্য করা যায়। কারো কারো তালিকায় ৪০টি নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এ থেকে কাতিবদের নিয়োগের ধরন ও কর্মধারা সম্বন্ধে আমরা ধারুা করতে পারি। লক্ষ্যণীয় যে, কাতিবগণ স্থায়ী, খন্ডকালীন বা অস্থায়ী কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url