ইসলামী রাষ্ট্রের যাকাত ব্যবস্থা

যাকাত বলতে কী বুঝায় তা বলতে পারবেন। যাকাতের উদ্দেশ্য কী তা লিখতে পারবেন। যাকাত কিভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে তা বর্ণনা করতে পারবেন। কার নিকট থেকে যাকাত আদায় করা হবে তা বলতে পারবেন। যাকাতুল ফিতর কী এবং এটি কিভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে তা বলতে পারবেন।


যাকাতের পরিচয়

যাকাত অত্যন্ত সুপরিচিত একটি শব্দ। ইসলামের ৫টি মূলভিত্তির একটি হচ্ছে যাকাত। আভিধানিকভাবে শব্দটি বরকত, প্রবৃদ্ধি, পরিশুদ্ধ বা পবিত্রতা অর্থে ব্যবহৃত হয়। ধনীদের মাঝে যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক তাদের সম্পদের সুনির্দিষ্ট একটা অংশ গরীবদের জন্য দান করা আল্লাহ তা'আলা বাধ্য করে দিয়েছেন। এটা গরীবদের অধিকার। ধনীদের সম্পদে গরীবদের জন্য নির্দিষ্ট এ অংশের নাম যাকাত।

যাকাত একটি অর্থনৈতিক ইবাদাত। সকল মানুষের উপর এটি আদায় করা জরুরী নয়। শুধু ধনীদের বেলায় যাকাত প্রযোজ্য।

সম্পদের যাকাত আদায়ের মাধ্যমে যাকাতদাতা তাতে বরকতের আশা পোষণ করে থাকেন, এর ফলে তার আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে এবং যাকাত আদায়ের ফলে সম্পদে প্রবৃদ্ধি ঘটে বিধায় এর নাম যাকাত হওয়াটা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত।

যাকাতের শরয়ী ভিত্তি

ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক ধনী ব্যক্তির উপর যাকাত আদায় করা যেমনিভাবে ফরয অনুরূপভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের উপর যাকাত আদায় করে তার সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে যাকাতের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনে চেষ্টা চালানো কর্তব্য। যাকাত ফরয হবার ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলা বলেন-

"মুমিন নর ও মুমিন নারী একে অপরের বন্ধু; এরা সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎকাজ নিষেধ করে, সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে।" 

( সূরা আত-তাওবা: ৭১ ) 

রাসুলুল্লাহ (স) ইরশাদ করেছেন-

"আল্লাহ তা'আলা ধনী মুসলমানদের সম্পদে এতটুকু পরিমাণ যাকাত আদায় করা ফরয করে দিয়েছেন যা তাদের গরীবদের জন্য যথেষ্ট হয়।" (তাবারানী)

ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেক ধনী মুসলমানের উপর স্বীয় সম্পদ থেকে যাকাত আদায় করা ফরয। অনুরূপভাবে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থবিভাগেরও দায়িত্ব ধনী মুসলমানদের থেকে যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-

তাদের সম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত) গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে।" (সূরা আত-তাওবা: ১০৩)

আল্লাহ তাআলা সূরা হজ্জের ৪১ নম্বর আয়াতেও ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের উপর যে সকল কাজ করা ওয়াজিব করে দিয়েছেন তার মধ্যে যাকাত আদায় করা অন্যতম।

রাসূল (স) একবার মুয়ায ইবনে জাবালকে ইয়ামেনের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে পাঠালেন। তিনি তাকে সেখানকার অধিবাসীর জন্য যে সকল কাজ করার দায়িত্ব অর্পণ করলেন তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সেখানকার ধনীদের থেকে যাকাত আদায় করে তা গরীবদের মাঝে বিতরণ করা। দীর্ঘ হাদীসে তিনি বলেন-

"তারা যদি এ সকল কাজের অনুসরণ করে তবে তাদের জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তা'আলা তাদের উপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন। এ যাকাত তাদের ধনীদের থেকে আদায় করা হবে এবং তাদের গরীবদের মধ্যে তা বিতরণ করা হবে।" (আবু দাউদ ও নাসাঈ)

উল্লেখিত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়, যে ইসলামী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যাকাত ব্যবস্থা একটি অপরিহার্য অংশ। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স) উভয়ই এ ব্যবস্থার প্রবর্তক।

আরো পড়ুন: মদীনা- ইসলামি রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ

যাকাত ব্যবস্থার উদ্দেশ্য

ইসলামী অর্থনীতিতে যাকাত ব্যবস্থা একটি দূরদর্শী ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা। কুরআন ও হাদীসের আলোকে এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের পেছনে যে সকল উদ্দেশ্য আছে বলে প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে,

১ সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন করা। এটাই হচ্ছে যাকাত ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। রাসূল (স) বলেন,

"তাদের (ধনীদের) সম্পদ থেকে যাকাত সংগ্রহ করবে এবং তাদের গরীবদের মাঝে তা বিতরণ করবে।" (আবু দাউদ)

২. যাকাত ব্যবস্থার ফলে মানুষের সম্পদের আবর্তন ও বিস্তার সাধিত হয়। অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ব্যবস্থার ফলে ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধি পায় আর গরীবরা সাচ্ছছল হযে উঠে।

৩. যাকাত ধনীদের আত্মার পরিশুদ্ধি সাধন করে। যাকাত আদায়ের ফলে ধনীর মন থেকে কার্পণ্য ভাব দূরীভিত হয়। তার মন দয়ালু হয়ে ওঠে। সমাজের অভাবী মানুষের প্রতি সে সহানুভূতিশীল হয়ে উঠে। আল্লাহ তা'আলা বলেন-

"তাদের সম্পদ থেকে সাদাকা (যাকাত) গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে।" (সূরা আত-তাওবা: ১০৩)

৪. যাকাত ব্যবস্থার ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধিত হয়। এর ফলে ধনীদের প্রদত্ত অর্থ যখন গরীবের হাতে চলে আসে তখন তারা এ অর্থ দিয়ে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করে, ফলে বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং মালের যোগান বেশী হয়। এতে সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে।

৫ যাকাত ঋণগ্রস্ত ও ভ্রমণরত ব্যক্তিদের সামাজিক সমস্যা লাঘব করে। ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি ও সমস্যাগ্রন্থ মুসাফির যাকাতের অন্যতম দু'টি খাত।

৬. ইসলামের সৌন্দর্যের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করণ এবং ইসলামী আদর্শকে প্রচার ও প্রসারের কাজ করা। এ উদ্দেশ্য হাসিল করতে যে অর্থের প্রয়োজন তা মেটানোর জন্য আল্লাহ তা'আলা যাকাত বাচের একটি খাত নির্ধারণ করেছেন।

অর্থাৎ যাকাতের সম্পদ তাদের (কাফিরদের) মন ইসলামী আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করতে ব্যয় করা হবে।

৭. বেকার সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখা যাকাতের অন্যতম উদ্দেশ্য। কেননা আল্লাহ তা'আলা ব্যক্তিগতভারে যাকাত আদায় করার চেয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়ের নির্দিশ দিয়েছেন এবং যাকাত আদায়কারী কর্মানীদের বেতন প্রদানের জন্য যাকাতের নির্দিষ্ট খাত রেখেছেন। আর এর ফলে বেশ কিছু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।

এক কথায় বলা যায়, অর্থনৈতিক মুক্তির এক মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আল্লাহ তা'আলা মুসলমান তথা ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন।

যাদের থেকে যাকাত আদায় করা যাবে

প্রত্যেক স্বাধীন মুসলমান ব্যক্তি যদি নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হন তবে তার উপর যাকাত ওয়াজিব হয়। ইবাদাত হিসেবে তার নিজের পক্ষ থেকেই যাকাত আদায়ের জন্য উদ্যোগী হতে হবে। আর ইসলামী রাষ্ট্র এ ধরনের ব্যক্তি থেকে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করবে।

এমনকি পাগল মুসলমান ও যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে তার অভিভাবক তার পক্ষ থেকে যাকাত আদায় করবেন।

আরো পড়ুন: ইসলামি রাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতি 

নিসাব পরিমাণ সম্পদ

ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, যানবাহন ও নিজের পেশাগত কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর পর অতিরিক্ত সম্পদ যদি শরীআত কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ হয় যার উপর উপর যাকাত ফরয হয় সে পরিমাণ সম্পদকে নিসাব বলে। তবে শর্ত হল এ সম্পদ ব্যক্তির নিকট কমপক্ষে এক বছর অতিক্রান্ত হতে হবে। যদি উক্ত সম্পদ তাঁর নিকট এক বছরের কম সময় থাকে তবে তাতে যাকাত দেয়া আবশ্যক নয়। ইসলামী রাষ্ট্রও তার থেকে যাকাত আদায় করতে পারবে না। এমনকি যদি কোন ব্যক্তি বছরের শুরুতে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় এবং বছরের শেষ দিকেও মালিক থাকেন কিন্তু বছরের মাঝামাঝি কোন সময় সম্পদ নিসাব পরিমাণ থেকে কমে যায় তাহলে তার উপর যাকাত আদায় করা ফরয নয়। রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন-

"সে সম্পদের কোন যাকাত দিতে হবে না যা মালিকের কাছে এক বছর অতিবাহিত হয়নি।

যে সব সম্পদে যাকাত দিতে হয়

কোন ব্যক্তি যদি নিম্নলিখিত সম্পদের যে কোন একটির কিংবা একাধিক বস্তুর নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় তবে তার থেকে ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত আদায় করবে। সাধারণত সোনা, রূপা, শষ্য, ফলমূল, ব্যবসায়িক পণ্য, মাঠে চরে বেড়ায় এমন পশু, খনিজ সম্পদ ও গুপ্তধনে যাকাত ওয়াজিব হয়।

সোনা রূপার নিসাব

সোনার নিসাব হচ্ছে সাড়ে সাত তোলা। আর রূপার নিসাব সাড়ে বায়ান্ন তোলা। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি সাড়ে সাত তোলা সোনার মালিক হন (৮৫ গ্রাম) কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মালিক হন আর তা এক বছর পর্যন্ত ভার মালিকানাধীন থাকে তবে তাকে উক্ত সম্পদের শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত আদায় করতে হবে। এ পরিমাণ যতই বাড়বে বর্ণিত যাকাতের হার তার হিসেবে বাড়তে থাকবে।

প্রচলিত মুদ্রার যাকাত

বর্তমান যুগে সোনা বা রূপার মুদ্রা নেই বললেই চলে। আছে কাগজের মুদ্রা ও পয়সা। এসব কাগজের মুদ্রা বা পয়সা ইত্যাদি সোনা ও রূপার স্থলাভিষিক্ত। তাই প্রচলিত মুদ্রার উপর যাকাত ফরয হবে। বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হলে তা মুদ্রায় হিসেব করে যাকাত আদায় করতে হবে। এ ধরনের সম্পদ নিজের ঘরে থাকুক কিংবা ব্যাংকে গচ্ছিত থাকুক যাকাত আদায় করতে হবে।

নগদ অর্থ (টাকা পয়সা) যেহেতু সোনা-রূপার স্থলাভিষিক্ত তাই কারো কাছে যদি সাড়ে সাত তোলা সোনা কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার দামের সমান অর্থ থাকে এবং নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয় তাহলে তা থেকে শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত আদায় করতে হবে।

বর্তমানে যেহেতু রূপার তুলনায় সোনার ব্যবহার ও লেনদেন বেশী তাই সোনার হিসেবে নগদ অর্থের নিসাব ধার্য করাই যুক্তিসংগত হবে, যদিও কোন কোন ফিকাহবিদ মনে করেন যে, সোনা এবং রূপার মধ্য থেকে যেটির হিসেব করলে প্রথমে যাকাত ওয়াজিব হয় সেটির হিসেবে টাকা-পয়সার উপর যাকাত ধার্য হবে। কারণ এতে গরিবদের সুবিধা রয়েছে।

মহিলাদের অলংকারের যাকাত

মহিলাদের অলংকার যদি উন্নতমানের হীরা, মুক্তা, পান্না ও পাথরের তৈরি হয় তাতে যাকাত আদায় করতে হবে না। তবে অংলংকার যদি সোনা কিংবা রূপার হয়, এবং তা নিসাব পরিমাণ হয় তাতে যাকাত আদায় করতে হবে। রাসূল (স.) বলেছেন-

"মুসলমান নারীদেরকে নির্দেশ দিন তারা যেন তাদের ব্যবহৃত অলংকারের যাকাত আদায় করে।"

রাসূল (স.)-এর সামনে একদা আসমা বিনতে ইয়াযিদ তার খালাসহ প্রবেশ করলে তিনি তাদের হাতে স্বর্ণালংকার দেখে বললেন, তোমরা কি এর যাকাত দাও? তারা বললেন, না। রাসূল (স.) বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে জাহান্নামের চুড়ি পরিয়ে দিবেন- তোমরা কি এ বিষয়টি ভয় কর? যদি ভয় করে থাক তবে এ অলংকারের যাকাত আদায় কর। (মুসনাদে আহমদ)

ব্যবসায়িক পণ্যের নিসাব

ব্যাবসায়িক পণ্যের ক্ষেত্রে নিসাব ধার্যের নিয়ম হল বছরের শুরুতে যে পরিমাণ পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করা হবে তা যদি নিসাব পরিমাণ অর্থের সমান হয় তবে তার যাকাত দিতে হবে। এবং বছরের মাঝখানে যে সকল পণ্য দোকানে ওঠানো হয় তাতে তখনই যাকাত আদায় করতে হবে যখন তার উপর এক বছর পূর্ণ হবে এর পূর্বে যাকাত দিতে হবে না। এভাবে প্রতি বছর শেষে ব্যবসায়িক পণ্যকে ব্যবসার মূলধন ধরতে হবে এবং তা যদি নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে তার উপর শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত দিতে হবে।

ভাড়া প্রদানকৃত বাড়ির উপর যাকাত

কোন ব্যক্তি যদি বাড়ি নির্মাণ করে তা ভাড়া দেয় এবং তা দ্বারা ব্যবসা করে তারও যাকাত আদায় করতে হবে। কারণ, তখন বাড়িটি তার থাকার জন্য প্রয়োজনীয় নয় বরং অর্থ উপার্জনের একটি মাধ্যম।

আরো পড়ুন: ইসলামি রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ও মূলনীতি

ফল-ফুল ও শস্যের যাকাত ও নিসাব

জমিতে যে সকল ফলমূল শস্য উৎপাদন করা হয় তার যাকাত আদায় করতে হবে। রাসূল (স.) এর আমলে গম, যব, খেজুর ও কিসমিসের যাকাত আদায় করা হত। তিনি বলেন-

"জমিতে যা কিছু উৎপন্ন হবে তার এক দশমাংশ যাকাত আদায় করতে হবে।"

ফলমূল ও শষ্যের নিসাবের পরিমাণ ৫ ওয়াসক বা ২৬ মন ১০ সের। এর কম হলে যাকাত আদায় করা আবশ্যক নয়। এ ধরনের সম্পদে জমি অনুযায়ী ওশর বা এক দশমাংশ কিংবা নিসফুল ওশর বা এক বিশমাংশ যাকাত আদায় করতে হবে। (৩য় পাঠে এ এ বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে)

পশুর যাকাত

যে সকল মালিকানাধীন পশু বছরের অধিকাংশ সময় মালিকের তত্ত্বাবধান ছাড়া মাঠে চরে বেড়ায় এ ধরনের উট গরু, ছাগল, ভেড়ার যাকাত আদায় করতে হবে। এগুলোকে সায়েমা (বিচারণকারী) পশু বলে। এগুলোর নিসাবের পরিমাণ হল উট ৫টি, গরু ৩০টি আর ছাগল ভেড়া ৪০টি। এ সংখ্যার কম হলে যাকাত আদায় করা আবশ্যক নয়।

যাকাত আদায় প্রক্রিয়া

যাকাত একটি ইবাদাত। ইসলামের ৫টি মৌলিক ভিত্তির একটি। কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে স্বীয় সম্পদের হিসেব করে নির্ধারিত পরিমাণ যাকাত আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত খাতে ব্যয় করে তবে তার উপর অর্পিত ফরয দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে।

তবে যাকাতের পরিমাণ সম্পদ পৃথক করে তা ইসলামী রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করাই সঠিক ও উত্তম পন্থা। কেননা ব্যক্তিগতভাবে যাকাত আদায় করে যতটা যাকাতের উদ্দেশ্য অর্জন করা যাবে তার চেয়ে অনেক বেশি অর্জন করা যাবে ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালে জমা দিলে। এর মাধ্যমে সমগ্র জাতির কল্যাণ সাধিত হবে। আল্লাহ তা'আলা ইসলামী রাষ্ট্রর কাছে যাকাত হস্তান্তরের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। রাষ্ট্র কর্তৃকক্ষকে তিনি বলেছেন-

"আপনি তাদের সম্পদের যাকাত আদায় করুন। যাতে তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে পারেন।" (সূরা আত-তাওবা: ১০৩)

সকল ব্যক্তি ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মালে স্বেচ্ছায় যাকাত প্রদানে এগিয়ে আসবে না। আর এটাই স্বাভাবিক। তাই ইসলামী রাষ্ট্রকে যাকাত আদায় করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রয়োজনে ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত আদায়ের জন্য একটি আলাদা বিভাগ গঠন করবে। নিযুক্ত কর্মকর্তা কর্মচারীরা যাকাত আদায়ের জন্য এমন পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যার ফলে প্রকাশ্য সম্পদ যেমন, শষ্য, ফল, গরু, ছাগল, উট প্রভৃতি গৃহপালিত পশু এবং অপ্রকাশ্য সম্পদ যেমন, সোনা-রূপা, টাকা-পয়সা ও ব্যবসায় পণ্য ইত্যাদির যাকাত সঠিক পরিমাণে আদায় করা যায়।

যাকাতের ব্যয়

ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত আদায় করার পর তা অন্যান্য ট্যাক্স এর সঙ্গে মিলাতে পারবে না বরং যাকাত ফান্ডের অর্থ সম্পূর্ণ পৃথকভাবে সংরক্ষণ করবে। আর এ অর্থ আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক নির্ধারিত ৮টি খাতে প্রয়োজন অনুসারে ব্যয় করতে হবে। এ খাত ছাড়া অন্য কোন কাজে ব্যয় করার সুযোগ নেই। (যাকাত ব্যায়ের খাতসমূহ ২য় পাঠে আলোচিত হয়েছে)।

যাকাত সম্পর্কে নীতিগত কথা হচ্ছে, এটা কোন ট্যাক্স নয়। মূলত, এটা অর্থনৈতিক ইবাদাত মাত্র। ট্যাক্স ও ইবাদাতের মৌলিক ধারণা ও নৈতিক ভাবধারার দিক দিয়ে উভয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। কাজেই যাকাতকে কোন ক্রমেই যেন ট্যাক্স মনে করা না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা ইসলামী রাষ্ট্রের জনগণের অন্যতম দায়িত্ব।

যাকাতকে রাষ্ট্রীয় আয় হিসেবে গণ্য করার কারণেও কারো মনে উক্ত ধারণা সৃষ্টি হওয়া আদৌ উচিত নয়। কেননা, মুসলমানদের সকল প্রকার সমষ্টিগত ইবাদাত বন্দেগির নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষার উদ্দেশ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা ইসলামী রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। তাই অর্থনৈতিক ইবাদাত-যাকাত-আদায়কেও তারই একটি খাত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে মাত্র। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, যাকাতের যে হার নবী করীম (স) ইসলামী শরীআতের বিধানদাতা হিসেবে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী নির্ধারণ করেছেন, তাতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার ক্ষমতা কারো নেই। কিন্তু টেক্স এর পরিমাণে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা বৈধ। কাজেই প্রয়োজনের তুলনায় যাকাতের হার স্বল্প মনে করে তাতে হ্রাস-বৃদ্ধি করা আল্লাহর শরীয়াতের উপর হস্তক্ষেপ এবং বড় অপরাধ বলে গণ্য হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে সে জন্য এ মূলনীতি সর্বজনস্বীকৃত হয়ে আসছে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url