আব্বাসীয়দের কেন্দ্রীয় সরকার পদ্ধতি
আব্বাসীয়দের কেন্দ্রীয় সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে বলতে পারবেন। আব্বাসীয় শাসনব্যবস্থায় উঘীর এবং হাজিব এর দায়িত্ব ও গুরুত্ব বর্ণনা করতে পারবেন আব্বাসীয়দের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।
ভূমিকা
আব্বাসীয়দের সুদীর্ঘ পাঁচ শত বৎসরের শাসনকাল মুসলিম শাসনব্যবস্থার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ যুগ। আব্বাসীয় যুগে উমাইয়া যুগের প্রচলিত শাসনব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। উমাইয়া যুগ ছিল প্রধানত যুদ্ধ বিগ্রহ ও রাজ্য বিস্তারের যুগ। কিন্তু আব্বাসীয় যুগছিল মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির যুগ, এ যুগ মুসলিম মননশীলতা ও শাসনতান্ত্রিক বিকাশের যুগ। এ যুগে মুসলিম শাসনব্যবস্থার প্রতিটি শাখায়, বিশেষ করে রাজস্ব ও বিচারব্যবস্থায়, অধিকতর সংগঠন ও দক্ষতা অর্জিত হয়। আব্বাসীয়রা উমাইয়াদের শাসনব্যবস্থায় শুধু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধনই করেননি, বরঞ্চ তারা এতে অনেক মৌলিক নীতিরও সংযোজন করেন। উমাইয়া আমলের ন্যায় আব্বাসীয় আমলেও রাজতন্ত্র ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। উমাইয়া খলীফাদের মত আব্বাসীয় খলীফাগণ উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতেন। তাঁরাও রাজদরবার প্রবর্তন করেন। তবে আব্বাসীয়রা প্রাচীন পারস্যের সাসানীয় নরপতিদের অনুকরণে রাজদরবারের জাঁকজমক বহুগুণে বৃদ্ধি করেন। ফলে আব্বাসীয় রাজশক্তির প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা ও ভীতি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। রাজদরবারের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক নিয়ম-কানুন এবং অসংখ্য সরকারী কর্মচারী, সভাসদ, অনুচরবর্গ, ভৃত্য ও দেহরক্ষী বাহিনী পরিবেষ্টিত ছিল। ফলে জনসাধারণ ও বিদেশ হতে আগত রাষ্ট্রদূতদের মনে খলীফার শক্তি ও প্রতাপ সম্পর্কে ধারণার সৃষ্টি হতো।
খলীফার দায়িত্ব ও কর্তব্য: উমাইয়া শাসনকালের মত আব্বাসীয় শাসনামলেও খলীফা ছিলেন রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী। খলীফা ছিলেন রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস। রাষ্ট্র শাসনের ব্যাপারে সকল গুরুত্বপূর্ণ আদেশ-নিষেধ তিনিই জারি করতেন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর ক্ষমতা ও কার্যাবলী প্রধানতঃ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল-ধর্মীয় ও রাজনৈতিক। খলীফার রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে আবার দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে-সামরিক ও বেসামরিক। আব্বাসীয় শাসনামলে উযীর এবং হাজীব ছিলেন খলীফার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
আব্বাসীয় উযীর: রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় খলীফার পর ছিল উযীরদের স্থান। উযীর ছিলেন রাষ্ট্র পরিচালনায় খলীফার প্রধান সাহায্যকারী। তিনি ছিলেন খলীফার প্রতিমূর্তি স্বরূপ। রাষ্ট্রীয় বেসামরিক শাসন ক্ষমতা তার উপর নাস্ত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি খলীফাকে রাষ্ট্রের সমুদয় প্রশাসনিক কার্যাবলীতে সাহায্য করতেন। খলীফাকে শাসন ব্যাপারে উপদেশ দেয়া খলীফার আদেশ নির্দেশ কার্যকর করা এবং খলীফার পক্ষে রাষ্ট্রের গোটা শাসনব্যবস্থার তদারক করা ছিল উযীরের অন্যতম কর্তব্য।
আরো পড়ুন:
হাজিব ও তার দায়িত্ব
খলীফা ও উযীরদের পর রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থায় হাজিব ছিলেন তৃতীয় প্রধান কর্মকর্তা। আব্বাসীয় শাসনের প্রথমদিকে উযীর ও হাজিব নামক দুই'জন পৃথক কর্মকর্তা ছিল বলে মনে হয় না। সম্ভবত ঐ সময় উঠীরই হাজিবের দায়িত্ব পালন করতেন এবং পরবর্তীকালে উষীরের কার্যাবলী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হাজিবের পদ সৃষ্টি হয়। মুসলিম শাসনব্যবস্থায় উমাইয়া খলীফা আবদুল মালিকই প্রথম হাজিবের পদ প্রবর্তন করেন। বিশাল রাষ্ট্রের অসংখ্য অত্যাচারিত জনগণ তাদের অভিযোগের প্রতিকারার্থে স্বভাবতঃই খলীফার সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা করত। কিন্তু খলীফার পক্ষে সব সময় জনগণের সাথে সাক্ষাৎ করা সম্ভব ছিল না। খলীফার পক্ষে হাজিবই জনগণের অভিযোগ শ্রবণ করতেন। অনেক অভিযোগ হাজিব নিজেই পূরণ করে দিতেন। কিন্তু যাদের অভিযোগ পূরণ করা হাজিবের পক্ষে সম্ভব হত না তিনি কেবল তাদেরকেই খলীফার নিকট উপস্থিত করতেন। জনগণকে খলীফার নিকট উপস্থিত করাই ছিল হাজিবের প্রধান কর্তব্য। বিদেশ হতে আগত রাষ্ট্রদূতদেরকেও হাজিব খলীফার সম্মুখে উপস্থিত ও পরিচয় করিয়ে দিতেন। প্রকৃতপক্ষে হাজিব ছিলেন খলীফার ঘনিষ্ঠ সহচর। তিনি সর সময় খলীফার সঙ্গে থাকতেন। খলীফার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার ফলেই হাজিবের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।
আব্বাসীয় খিলাফতের কেন্দ্রীয় প্রশাসন
আব্বাসীয় শাসন আমলে কেন্দ্রীয় সরকরের প্রশাসনিক কার্যাবলী প্রধানতঃ ফিলিখিত প্রশাসনিক বিভাগের উপর নাস্ত ছিল।
দীওয়ান আল-জুন্ন্দ (সামরিক বিভাগ): উমাইয় যুগের মত এ যুগেও কেন্দ্রীয় সামরিক বিভাগ দীওয়ান
আল-জুনদ নামে অভিহিত ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের সৈন্য নিয়োগ, সৈন্যদের বেতন ও ভাতা বন্টন এবং যাবতীয় সামরিক চাহিদা পূরণ কেন্দ্রীয় সামরিক বিভাগের অন্যতম দায়িত্ব ছিল। সামরিক বিভাগ প্রধানতঃ সামরিক বিভাগের প্রশাসনিক কার্যাবলী পরিচালনা করত। এ বিভাগের মজলিস আল-মুকাবাহ শাখা সৈন্য নিয়োগ মজলিস আল-তাকবীর শাখা সৈন্যদের বেতন ও ভাতা বন্টন এবং আল-আরয শাখা অস্ত্রাগারে সামরিক সাজ সরঞ্জাম পরীক্ষা করতো।
দীওয়ান আল-খারাজ (রাজস্ব বিভাগ): এ বিভাগ রাষ্ট্রীয় রাজস্ব ব্যাপারে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিল। রাজস্বনীতি নির্ধারণ, রাজস্ব ধার্য ও আদায় করা, রাজস্বের আয়-ব্যয়ের হিসাব রক্ষা করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের যাবতীয় প্রশাসনিক ব্যয় বহন যথা সরকারী কর্মচারীদের বেতন ও ভাতা বণ্টন এবং সরকারের সমুদয় উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কাজে অর্থ যোগান এ বিভাগের প্রধান দায়িত্ব ছিল।
দীওয়ান আল-বারীদ (ডাক বিভাগ): মহানবী (স) এবং ধর্মপ্রাণ চার খলীফার আমলে ডাক ব্যবস্থা চালু ছিল না। তাঁদের আমলে রাষ্ট্রীয় চিঠিপত্র আদান-প্রদানের জন্য ব্যক্তি বিশেষকে পত্রবাহক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু উমাইয়া যুগে খলীফা মুআবিয়া (রা) সাসানীয় শাসনের অনুকরণে মুসলিম শাসনব্যবস্থায় প্রথম ডাক ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং ডাক ব্যবস্থা তত্ত্বাবধানের জন্য দীওয়ান আল-বারীদ নামে রাষ্ট্রীয় ডাক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। আব্বাসীয় শাসনকালে ডাক ব্যবস্থার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব, নিরাপত্তা ও অগ্রগতির মূলে ডাক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার উপর আব্বাসীয় খলীফাগণ যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করতেন।
কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে খবরাখবর আদান প্রদান, কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্বন্ধে অবহিত করণ এবং প্রাদেশিক সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট গোপন রিপোর্ট প্রেরণ করা ছিল ডাক বিভাগের প্রদান কর্তব্য। এ বিভাগে নিয়োগ সকল কর্মচারী রাষ্ট্রীয় খবরাখবর সংগ্রহ এবং রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা তৎপরতায় নিয়োগ ছিল। অতএব ডাকবিভাগকে এক সঙ্গে রাষ্ট্রের গুপ্তচর বিভাগের দায়িত্বও পালন করতে হতো।
রাষ্ট্রের গোটা ডাক ব্যবস্থা তত্ত্বাবধানের ভার কেন্দ্রীয় সাহিব আল-বারীদের উপর ন্যস্ত ছিল। তিনি প্রাদেশিক বারীদের কার্যাবলী তত্ত্বাবধান করতেন, প্রদেশের বিভিন্ন শহরে ডাক কর্মকর্তা নিয়োগ করতেন, সাম্রাজ্যের সকল গুরুত্বপূর্ণ রাজপথের ডাক ষ্টেশনে উপযুক্ত ডাক কর্মচারী ও ডাক বাহক মোতায়েন করতেন এবং তাদের বেতন ও রসদ সরবরাহের তত্ত্বাবধান করতেন। সাহিব আল বারীদ তার প্রাদেশিক সহকারীদের নিকট হতে প্রাদেশিক সরকার সম্পর্কে প্রাপ্ত খবর হুবহু এবং কোন কোন সময় তাদের খবরের উপর ভিত্তি করে তারা নিজস্ব রিপোর্ট প্রয়োজন অনুসারে খলীফা এবং প্রয়োজন অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রশাসনিক বিভাগের নিকট প্রেরণ করতেন। অনেক সময় প্রাদেশিক ডাক প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ খবরের অংশ বিশেষ কেন্দ্রীয় ডাক বিভাগে সংরক্ষিত রাখা হতো।
ডাক ব্যবস্থার প্রধান সাহিব আল-বারীদ রাষ্ট্রের গোয়েন্দা ব্যবস্থারও প্রধান ছিলেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, গোয়েন্দা তৎপরতায় ডাক বিভাগের সকল কর্মচারী নিয়োজিত ছিল। ডাক প্রধান ও গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে সাহিব আল-বারীদের পূর্ণাঙ্গ উপাধি ছিল সাহিব আল-বারীদ ওয়াল-আখবার।
দীওয়ান আল-রাসায়িল (পত্র লিখন বিভাগ): মহানবী (স) এবং খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে সরকারী চিঠি-পত্র লিখার ভার ব্যক্তি বিশেষের উপর ন্যস্ত ছিল। কিন্তু উমাইয়া যুগে এ দায়িত্ব পালনের জন্য দীওয়ান আল-রাসায়িল নামে একটি পূর্ণাঙ্গ পত্র লিখন বিভাগ স্থাপিত হয়। খলীফা মুআবিয়া (রা) এ বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। আব্বাসীয় যুগে দীওয়ান আল-রাসায়িল রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দফতর হিসেবে গণ্য ছিল। সরকারী চিঠি-পত্র এ বিভাগেই লিখিত হত এবং লিখিত চিঠিপত্র ও ফরমান খলীফা কিংবা উঠীরের অনুমোদনের পর এ বিভাগে যথারীতি সীলমোহর করা হতো।
দীওয়ান আল-খাতাম (রেজিট্রেশন বিভাগ): সরকারী চিঠিপত্র ও আদেশ নির্দেশে জালিয়াতির সম্ভাবনা দূর করার জন্য উমাইয়া খলীফা মুআবিয়া রাষ্ট্রীয় রেজিট্রেশন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এ বিভাগে সরকারী গুরুত্বপূর্ণ চিঠিপত্র ও দলিলের অনুলিপি রাখা হতো এবং মূলকপি সীলমোহর করে নির্দিষ্ট ব্যক্তি কিংবা বিভাগের নিকট প্রেরণ করা হতো। আব্বাসীয় খিলাফতের প্রারম্ভিক যুগে (খলীফা আল-আমীনের খিলাফত পর্যন্ত) রেজিষ্ট্রেশন বিভাগ বলবৎ ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এ বিভাগের কার্যাবলী দীওয়ান আল- ভাওকী নামে সরকারের অন্য এক বিভাগ পালন করতো।
দীওয়ান আল-তাওকী (অনুরোধ বিভাগ): খলীফার নিকট জনগণের লিখিত আবেদন পত্রের উপরৎখলীফার সিদ্ধান্ত ও মতামত তাওকী নামে অভিহিতো আবেদন পত্রের উপর খলীফা নিজে কিংবা তাঁর বাক্তিগত সচিব অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ও সংক্ষিপ্ত আকারে সিদ্ধান্ত লিখতেন। কেন্দ্রীয় অনুরোধ বিভাগ খলীফার এসব সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আনুষ্ঠানিক আদেশনামা তৈরী এবং অনুলিপি রাখার পর আদেশনামা সীল মোহরকৃত অবস্থায় নির্ধারিত ব্যক্তির নিকট প্রেরণ করা হতো।
দীওয়ান আল-আযিম্মা (হিসাব নিরীক্ষণ বিভাগ): খলীফা আল-মাহদী সরকারের আর্থিক লেনদেন সম্বন্ধীয় প্রশসনিক বিভাগসমূহের দূর্নীতি দমন ও প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উক্ত বিভাগসমূহের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষণের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। হিসাব নিরীক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারে দীওয়ান আল-আযিম্মা এবং প্রাদেশিক সরকারে দীওয়ান আল-যিমাম নামক হিসাব নিরীক্ষণ বিভাগ স্থাপন করা হয়। হিসাব নিরীক্ষণের সুবিধার্থে দীওয়ান আল-আযিম্মা কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব সংক্রান্ত বিভাগসমূহের (দীওয়ান আল-খারাজ দীওয়ান আল-দিয়ার, দীওয়ান আল-সাওয়াফি এবং দীওয়ান আল-নাফাকাত প্রভৃতি) জন্য পৃথক কর্মকর্তা নিয়োগ ও পৃথক হিসাব রেজিষ্টার (যিমাম) রক্ষা করতো। প্রাদেশিক হিসাব নিরীক্ষণ বিভাগও প্রাদেশিক সরকারের অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতো। এ বিভাগের প্রধানের উপাধি ছিল সাহিব দীওয়ান আল-আযিম্মা। তার সহকারীকে নায়েব দীওয়ান আল-আযিম্মা বলা হতো।
আরো পড়ুন:
দীওয়ান আল-দীয়ার (খলীফার ব্যক্তিগত সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ) : খলীফা আবু বকর ও উমর (রা) অত্যন্ত সরল জীবন যাপন করতেন। তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। অতি নগণ্য রাষ্ট্রীয় ভাতায় তাঁরা নিজেদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে খলীফাদের ধন-সম্পদ লাভের প্রবণতা দেখা দেয়। আব্বাসীয় যুগে সাম্রাজ্যের প্রায় সকল প্রদেশেই খলীফাগণ ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। খলীফার ব্যক্তিগত সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের ভার দীওয়ান আল-দিয়ার এর উপর ন্যস্ত ছিল।
দীওয়ান আল-নাফাকাত (রাজকীয় পারিবারিক ব্যয় সংক্রান্ত বিভাগ): রাজ দরবার ও রাজপ্রাসাদ সংক্রান্ত যাবতীয় খরচ এ বিভাগ হতেই বহন করা হতো। রাজ দরবার ও রাজপ্রাসাদে নিয়োগ কর্মচারীদের বেতন রসদ বন্টন, রাজকীয় প্রাসাদ নির্মাণ ও মেরামত এবং রাজ আস্তাবলের তত্ত্বাবধান এ বিভাগের উপর ন্যস্ত ছিল। আব্বাসীয় যুগে রাজকীয় জাঁকজমক বহু গুণে বৃদ্ধি পায়। এ যুগে রাজপ্রাসাদে ও রাজ দরবারে নিয়োগ কর্মচারীর সংখ্যা ছিল অনেক। খলীফার দেহরক্ষী বাহিনী খলীফার ব্যক্তিগত কর্মসচিব রাজকীয় কুর'আন পাঠক রাজকীয় জ্যোতিষ হাস্য রসিক পাঠক চিকিৎসক প্রভৃতি দরবারে নিয়োগ কর্মচারীর মধ্যে অন্যতম। রাজদরবার ও রাজ প্রাসাদের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় হতো। একমাত্র রাজকীয় রন্ধনশালা ও রুটী তৈরী কারখানার জন্য মাসে ১০,০০০ দীনার বরাদ্দ থাকতো।
দীওয়ান আল-সাওয়াফী (রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি তত্ত্বাবধান বিভাগ): মুসলিম বিজয়ের সময় প্রাক্তন রাজবংশ ও অভিজাত ব্যক্তিদের পরিত্যক্ত ভূসম্পত্তি যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের জমি পারস্যের সাসানীয় শাসনাধীন অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় অগ্নিমন্দিরের জন্য উৎসর্গকৃত জমি এবং ডাক বিভাগের ব্যয় নির্বাহের জন্য নির্ধারিত জমি মুসলমানেরা রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ কর্তৃত্বাধীনে আনয়ন করেন। এ সব রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির তত্ত্বাবধান, রাজস্ব আদায় এবং রাজস্বের আয়ব্যয়ের হিসাব রক্ষণ দীওয়ান আল-মাওয়াফীর উপর ন্যস্ত ছিল।
দীওয়ান আল-নযর ফিল্-মাযালিম (অভিযোগ পর্যালোচনা বিভাগ): সরকারী কর্মচারীদের দুর্নীতি
জনগণের উপর অত্যাচার-অবিচার, তহবিল তসরুফ প্রভৃতি অসদাচরণের তদন্ত ও প্রতিকার এ বিভাগের প্রধান কর্তব্য ছিল। অন্যায়ভাবে জনগণের অধিকৃত সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা, সরকারী ভাতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ভাতা কমিয়ে বা বন্ধ করে দেয়ার অভিযোগ শ্রবণ ও প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ, মুহতাসিবের আদেশ নির্দেশ কার্যকর করতে তাকে সাহায্য প্রদান, কাযীর রায় আইন সম্মত না হলে সে ব্যাপারে তার দৃষ্টি আকর্ষণ ও পুনঃবিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এ বিভাগের উপর ন্যস্ত ছিল। দীওয়ান আল-মাযালিম ছিল প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ফৌজদারী আপিল আদালত। খলীফা নিজে কিংবা উমীর, কিংবা রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি কিংবা খলীফা কর্তৃক নিয়োগ প্রাপ্ত কোন দায়িত্বশীল বাক্তি মাযালিম বিভাগে সভাপতিত্ব করতেন।
দীওয়ান আল-কাযা (বিচার বিভাগ): বিচার ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কেন্দ্রীয় রাজধানী বাগদাদে এবং সাম্রাজ্যের প্রত্যেক প্রাদেশিক রাজধানীতে ও শহরে কাযী নিয়োগ ছিলেন। কাযীরা ছিলেন বিচার কার্যে খলীফার প্রতিনিধি। কারণ খলীফা রাষ্ট্রীয় বিচারের উৎস এবং সর্বোচ্চ প্রধান বিচারক। তৃতীয় আব্বাসীয় খলীফা মাহদী মুসলিম শাসনব্যবস্থার প্রথম প্রধান বিচারক ছিলেন। তৃতীয় আব্বাসীয় খলীফা মাহদী মুসিলম শাসনব্যবস্থার প্রথম প্রধান বিচারপতির (কাজী আল-কুযাত) পদ সৃষ্টি করেন। তিনি ইমাম আবু হানীফার শিষ্য ইমাম আবু ইউসুফকে উক্ত পদে নিয়োগ করেন। আবু ইউসুফ খলীফা মাহদী, হাদী ও হারুন অর-রশীদের শাসনকালে কাযী উল-কুযাত পদে আসীন ছিলেন। কাযী উল-কুযাত রাষ্ট্রের বিচার ও ধর্মীয় ব্যবস্থা তত্ত্বাবধান করতেন।
পুলিশ বিভাগ
আব্বাসীয় যুগে পুলিশ সংগঠন ব্যবস্থার ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ যুগে পুলিশ বাহিনী নিলিখিত চারটি বিশেষ শাখায় সংগটিত ছিল।
• শূরতা (সাধারণ পুলিশ বাহিনী) এর প্রধান সাহিব আল-শুরতা নামে অভিহিত ছিলেন।
• মা'উনা (সামরিক পুলিশ বাহিনী) এর প্রধানের উপাধি ছিল সাহিব আল-মা'উনা।
• হারাস (প্রহরী পুলিশ বাহিনী) এ বাহিনীর প্রধান সাহিব আল-হারাস নামে অভিহিত ছিলেন।
• আহদাস (বিশেষ পুলিশ বাহিনী) এর প্রধানের উপাধি ছিল সাহিব আল-আহদাস।
দীওয়ান আল-হিসবাহ: এটি পুলিশ বিভাগের মত এক প্রকারের আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকারী বিভাগ। নাগরিক জীবনে সর্ব প্রকারের অপরাধমূলক তৎপরতা দমনে এবং শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় পুলিশ বিভাগ যথেষ্ট ছিল না। তাই তৃতীয় আব্বাসীয় খলীফা আল-মাহদী দীওয়ান আল-হিসবাহ নামে এ বিশেষ আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকারী বিভাগ স্থাপন করেন। আইন শৃঙ্খলার অগ্রগতি সাধন এ বিভাগের প্রধান কর্তব্য ছিল।
অন্যান্য দপ্তর
উপরোক্ত প্রশাসনিক বিভাগগুলো ব্যতীত আব্বাসীয় যুগে কেন্দ্রীয় শাসন-ব্যবস্থায় আরও অনেক ছোটখাট প্রশাসনিক বিভাগ প্রতিষ্ঠিত ছিল। এগুলোর মধ্যে দেয়ান আল-আকরিয়া (কৃষি বিভাগ), দীওয়ান আল-মুকাতিয়াত (সরকারী সাহায্য বিভাগ), দীওয়ান আল-মুসাদেরীন (সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ বিভাগ) দীওয়ান আল-মাওয়ালী ওয়াল-গীলমান (দাসদাসী ও আশ্রিতদের রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url