মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের সামরিক বিভাগ
মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের সেনা বিভাগের অপরিহার্যতা সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন;মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কাঠামো সম্পর্কে বলতে পারবেন, মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর বিন্যাস সম্পর্কে লিখতে পারবেন, শিবির অধিনায়ক ও সৈন্য গণনা সম্পর্কে জানতে পারবেন;আশ্বারোহী বাহিনী সম্পর্কে লিখতে পারবেন।
মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের সামরিক বিভাগের প্রয়োজনীয়তা
যে কোন রাষ্ট্রের জন্য একটি সুসংগঠিত, সেনাবাহিনী থাকা অপরিহার্য বিষয়। মহানবী (স)-এর মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রেও-এর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় এবং একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করা হয় নিম্নে এর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরা হল:
মদীনায় একটি নতুন সামরিক অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে একটি সামরিক সংগঠনের ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও অপরিহার্যরূপে এসে যায়। মদীনার দুর্বল ও সংখ্যার দিকে নিতান্তই স্বল্প মুসলিম সম্প্রদায় হিজরতের পর প্রকৃত পক্ষে এমন একটি ভূখন্ডে বাস করতে থাকে যার চারদিকে ঘিরে ছিল একটি প্রবল বিরোধী শত্রু পক্ষ। মদীনার মুসলমানদের সামনে যে বড় বিপদ দেখা দেয় সেটি ছিল মক্কাবাসীদের তরফ থেকে প্রতিনিয়ত একটি আক্রমণের আশংকা। কারণ, মহানবী (স) ও তাঁর সাহাবীগণ মক্কার কাফিরদের রুদ্ররোষের কারণে মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত চলে আসেন। এমনকি এখানে নতুন আবাসস্থলেও মুসলমানদের শত্রুর শেষ ছিল না। এই নগরীর ইয়াহুদীরা মহানবী (স) ও তাঁর ধর্মবিশ্বাসের বিরোধিতা করাকেই বেছে নেয়। আর এটা মুসলমানদের অস্তিত্বের উপর একটি নয়া হুমকি সৃষ্টি করে। মুনাফিকদের শত্রুতাও তাদের জীবনকে করে তুলে আরো দুর্বিসহ। এই দু'টি অভ্যন্তরীন বৈরিতা ছাড়াও এলাকার পৌত্তলিক আরব উপজাতিগুলো তাদের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ায়। এসব বহুবিধ হুমকি ও বিপদের মুখে মদীনার শিশু ইসলামি রাষ্ট্রকে তার সামরিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হয়। অন্যথায় তার অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার সমূহ আশংকা ছিল।
বিধর্মী শত্রু পরিবেষ্টিত পরিমন্ডলে মুহাম্মদ (স) মদীনার ইসলামি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, নিরাপত্তা ও সংহতির জন্য স্থায়ী প্রতিরক্ষা বাহিনী (আর্মি) গড়ে তুলেছিলেন। তিনি এক দশকের মধ্যেই ইসলামি রাষ্ট্রের সামরিক সংগঠনকে এমনভাবে গড়ে তুলেছিলেন যে, বিশ্ববাসী অতি উন্নত এক সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখতে পেয়েছিল। সময়ের প্রয়োজন ও সামরিক প্রতিরক্ষা ও রুকৌশল বিবেচনায় রেখে তিনি সামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ দিতেন।
সেনাবাহিনীর অবকাঠামো
মহানবী (স) তাঁর সেনাবাহিনীর জন্য একটি চমৎকার ও আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন, তাঁর
সেনাবাহিনীর কাঠামোর মধ্যে ছিলঃ
- সেনানায়কবৃন্দ (উমারা আল-সারিয়া),
- সামরিক কর্মকর্তাগণ (উমারা আল মায়মানাহ, মায়সারাহ, মুকাদ্দামাহ ও সাকাহ),
- পতাকাবাহী (সাহিব আল লিওয়া ওয়া'আর-রায়াহ),
- স্কাউট (তালিআহ),
- গুপ্তচর (উয়ূন),
- পথ প্রদর্শক (দালীল)
- যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পদ ও যুদ্ধবন্দীদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ (আসহাবু'ল মাগানিম ওয়া'ল উসারা),
- যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধের অর্শ্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ (আসহাবু'স সিলাহ ওয়া'ল ফারাস)
- দেহরক্ষীগণ (আসহাবু'ল হারাস)।
ইসলামি সেনা বাহিনীর বিন্যাস
মহানবী (স) তাঁর যুদ্ধকালে সেনা পরিচালনায় অনেক সময় "আল-খামিস" পদ্ধতি অনুসরণ করে সেনাবাহিনীকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। এগুলো ছিল-
- কালব (কেন্দ্রীয় বাহিনী),
- মায়মানাহ (দক্ষিণবাহু),
- মায়সারাহ (বামবাহু),
- মুকাদ্দামাহ (অগ্রবর্তী বাহিনী)
- সাকাহ (পশ্চাদরক্ষী)।
নবী করীম (স) তাঁর রাষ্ট্র পরিচালনার জীবনে ৮০টি যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। 'গাজওয়াত' বা বড় যুদ্ধ যাতে তিনি নিজে সেনাপতি হিসেবে অংশ নিয়েছেন এমন যুদ্ধের সংখ্যা ২৭টি। এছাড়া অন্যগুলো ছিল 'সারায়া'। সেগুলোতে তিনি সাহাবী ও সেনাধ্যক্ষদের অভিযান পরিচালচনায় নেতৃত্ব দিয়ে (আমীর আল-আসকার বা সেনাপতি নিযুক্ত করে) পাঠিয়েছেন। তিনি কনভেশনাল ফ্রন্টাল ওয়ার, গেরিলা ওয়ার, সাইকোলজিক্যাল ওয়ার, সব কৌশলই প্রয়োজন মত ব্যবহার করেছেন। ট্রেঞ্চ খোঁড়া, আক্রমণ ও পশ্চাদপসরণ সব পদ্ধতিই ব্যবহার করেছেন। ঈমানের বলে বলীয়ান সুশংঙ্খল ইসলামি সেনাবাহিনীর বিন্যাস, পরিচালনা পদ্ধতি ও রুকৌশল এমন উন্নতভাবে গৃহীত হত যে, একের পর এক বিজয় মুসলমানরা পেয়েছিল। বদরের যুদ্ধে আল্লাহর অশেষ কৃপায় মাত্র ৩১৩ জন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে জয়লাভ শুরু হয়। এভাবে মক্কা থেকে হিজরতের মাত্র ৮ বছরের মধ্যেই ফতহে মক্কা বা মক্কা বিজয় সম্ভব হয়। এছাড়া পুরো আরব উপদ্বীপকে মুসলিম বাহিনী বিজয়ের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করে মদীনা কেন্দ্রিক ইসলামি রাষ্ট্রের আওতায় আনতে সক্ষম হয়। কুফর ও খোদাদ্রোহীদের পরাজয় এবং তৌহিদের বিজয় সুচিত হয়।
আল-হারাস
বৈরিতার সময় ইসলামি সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে উত্থিত চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করার জন্য রাজধানীর বাইরে চলে গেলেও রাজধানীতে একটি সেনা গ্যারিসন মোতায়েন থাকত, যাতে সেনাবাহিনীর অবর্তমানে আশপাশের কোন বৈরী গোত্রের হামলার বিরুদ্ধে রাজধানীর মুসলমানরা আত্মরক্ষা, প্রতিশোধ বা পাল্টা আক্রমণ চালাতে পারত। ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকে এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের পরেও মদীনার মুসলমানগণ নিজেদের খুব একটা নিরাপদ ভাবতে পারত না। কারণ, স্বার্থ লোভী মুনাফিক ও ইয়াহুদী গোত্রের শাখাগুলো রাজধানী শহরের বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য শক্তি সঞ্চয়ে ব্যস্ত থাকত। এমতাবস্থায় সদর দফতরের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে অধিক মনোযোগ প্রদান ও প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। মহানবী (স) যখনই রাজধানীর বাইরে যেতেন, তার অনুপস্থিতিতে মদীনার উপর বাইরের হামলা প্রতিরোধ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ দমনের উপযোগী একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী রেখে যেতেন। এমন কি তাঁর মদীনায় অবস্থানকালেও বাইরের কোন মারাত্মক হামলা মোকাবেলায় তিনি এ কর্তব্য পালনে সচেতন থাকতেন।
সেনাবাহিনীর অন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগসমূহ
এ ছাড়া সেনা শৃঙ্খলার জন্য ছাউনি ও শিবির অধিনায়ক, নৈশ প্রহরা, সৈন্য গণনা, প্রশিক্ষণ, জনবল বৃদ্ধি ইত্যাদি ব্যবস্থা রেখেছিলেন। মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী আরও যে সকল বিভাগে বিভক্ত ছিল তা হল:
১। ইনফেন্ট্রি বা পদাতিক (মুশাত)
২। ক্যাভেলরী বা অশ্বরোহী (আল-খায়ল),
৩। তীরন্দাজ (রুমাত),
৪। বর্মধারী সৈন্য (আহলু'ল সিলাহ) এবং
৫। সাপ্লাই কোর বা রসদবাহী।
কেন্দ্রীয় সামরিক বাহিনী ছাড়া প্রাদেশিক সামরিক সংক্রান্ত প্রশাসন প্রাদেশিক গভর্ণরের অধীনে 'বিলায়াত' ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হত। রাসূল (স) ইসলামি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখায় গোত্রীয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতেন। ইসলামি রাষ্ট্রের অস্ত্র ভান্ডারকে ক্রমাগত যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করা হয়েছিল। সেগুলোর দায়িত্বে থাকতেন নির্দিষ্ট সামরিক কর্মকর্তাগণ। এছাড়া সামরিক অভিযানকালে দেহরক্ষী প্রথাও চালু করেছিলেন তিনি।
আরো পড়ুন: ইসলামী রাষ্ট্রের যাকাত ব্যবস্থা
অশ্বারোহী বাহিনীর ক্রমান্বয় অগ্রগতি
পদাতিক বাহিনীই ছিল সেনাবাহিনীর মূল অংশ। পরবর্তীকালে অশ্বারোহী বাহিনী প্রচলনের ফলে তাদের প্রধানা হ্রাস পায়।
মহানবী (স)-এর প্রধান অভিযানসমূহে ব্যবহৃত অশ্ব ও অশ্বারোহীর সংখ্যার একটি পর্যালোচনা এখানে উল্লেখের দাবি রাখে। কারু এ থেকে ইসলামি রাষ্ট্রের অশ্বারোহী বাহিনীর শক্তির ক্রম বিকাশের পরিচয় পাওয়া যারে। বস্তুত অশ্বরোহী বাহিনী ক্রমান্বয়ে বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ২ হিজরীতে (৬২৪ খৃষ্টাব্দ) অনুষ্ঠিত প্রথম খন্ড যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর মাত্র ২টি অশ্ব ছিল। পক্ষান্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী মক্কার বাহিনীর ছিল ১০০টি। ৬ মাস পর কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে মুসলিম বাহিনীর হাতে মাত্র কয়েকটি অশ্ব ছিল। ৩ হিজরীর শাওয়াল মাসে (৬২৫ খৃষ্টাব্দে মার্চ) মদীনার মুসলিম বাহিনীতে ছিল মাত্র ৫০টি অশ্ব অথচ কুরায়শ বাহিনীতে ছিল ৩ হাজার সৈন্য, ২শ অশ্ব। মুরায়সী অভিযানকালে মুসলিম অশ্বারোহী সৈন্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০ জন। কিন্তু ৫ম হিজরীর (৬২৭ খৃষ্টাব্দ) যিলকদ মাসে খন্দক অভিযানকালে মুসলিম অশ্বারোহী বাহিনীর সংখ্যা ৫০০তে পৌছেছিল। ৩০০ ও ২০০, এ দু'টি দলে বিভক্ত এ বাহিনীকে মদীনা রক্ষার জন্যে নিয়োজিত করা হয়েছিল।
শিবির অধিনায়কগণ
সাধারণত ইসলামি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক তার শিবিরেরও অধিনায়ক ছিলেন। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে শিবিরের জন্যে স্বতন্ত্র অধিনায়কও নিয়োগ করা হত। ওয়াকিদী সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে হাশিম গোত্রের হযরত আলী এবং উমাইয়া গোত্রের হযরত উসমান ইবন আফফান বন্ নাযীর ও খায়বার অভিযানকালে মুসলিম শিবিরের অধিনায়ক ছিলেন। মহানবী (স) তাঁর অনুপস্থিতিতে তাদেরকে ইসলামি বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার পদে নিয়োগ করেছিলেন। খায়বার অভিযানকালে মহানবী (স) শিবির থেকে দূরে অবস্থানকালে উমাইয়া গোত্রের হযরত উসমান ইবন আফফান (রা) কে তার ডেপুটি এবং তার সাথে সাথে শিবিরেরও অধিনায়ক নিযুক্ত করেছিলেন।
সৈন্য গণনা
মহানবী (স) এর সামরিক সংগঠনের আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সেনা সমাবেশ (আরয)। সেনা সমাবেশের দায়িত্ব বিশেষভাবে অভিজ্ঞ সাহাবীদের উপরই তিনি অপর্ণ করতেন। সাধারুত স্থায়ী সেনাবাহিনী না থাকার কারণে সৈন্য সংগ্রহ করার সাথে সাথেই তাদের সমাবেশ ও গণনার ব্যবস্থা করা হতো। কোন কোন সময় সৈন্যদের অভিযানে যাওয়ার আগে অথবা যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার অব্যবহিত পূর্বেও সংগ্রহকৃত সৈন্যের গণনা কাজ সমাধা করা হত। এটা নিশ্চিত যে মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধ থেকেই সেনা সংগ্রহ ও গণননার ব্যাপারটি চালু হয়।
পরিশেষে বলা যায়, মদীনা ইসলামি রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষনে জন্য সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। মহানবী (স)-এর অবকাঠামো গড়ে তোলা ও বিন্যাসের মাধ্যমে সে প্রয়োজনীয়তা পূরণে সম্পূর্ণভাবে সক্ষম হন। তিনি সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে এক অনন্য সাধারু সামরিক ব্যবস্থাপনার নজীর রেখে যান, যা পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে এবং যুগযুগ ধরে এ আদর্শ অনুকরু যোগ্য হয়ে থাকবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url