খোলাফায়ে রাশেদূন সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো ও বিচার বিভাগ
এই আর্টিকেলটিতে খোলাফায়ে রাশেদূানর সরকার কাঠামো সম্পর্কে লিখতে পারবেন, খোলাফায়ে রাশেদূনের বিচার ব্যবস্থার বিবরণ দিতে পারবেন।
ভূমিকা
ইসলামি শাসনতন্ত্রের ইতিহাসে খোলাফায়ে রাশেদুন সরকার পদ্ধতি একটি যুগান্তকারী শাসন কাঠামো। তবে খোলাফা রাশেদূনের মধ্যে হযরত আবু বকর রা. প্রশাসনিক উন্নতি বিধানে বিশেষ দৃষ্টি দিতে পারেন নি। কারণ, বিদ্রোহী ও ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তাঁর শাসনকালের সমাপ্তি ঘটে। হযরত উমরই (রা) ছিলেন প্রকৃত পক্ষে ইসলামি সরকার পদ্ধতি সংস্কারের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। নিম্নে খোলাফায়ে রাশেদুন সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
খোলাফায়ে রাশেদূন বিশেষ করে হযরত উমর (রা) প্রশাসনিক সুবিধার জন্য সমগ্র আরব সামাজ্যকে ৮টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। সেগুলো হচ্ছে মক্কা, মদীনা, সিরিয়া, আল-জাযীরা, বসরা, কুফা, মিসর ও জেরুসালেম। রোমান শাসনামলে জেরুসালেম ১০টি জেলায় বিভক্ত ছিল। খলীফা উমর জেরুসালেমকে প্রধান ২টি বৃহৎ অঞ্চলে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেকটি অঞ্চলের জন্য পৃথক পৃথক ওয়ালী বা প্রাদেশিক গভর্নর নিযুক্ত করেন। তাদের রাজধানী ছিল আইলা ও রামলা। মিসরকে তিনি উচ্চ মিসর (Upper Egypt) এবং নিম্ন মিসর (Lower Egypt) এ দু'টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। উচ্চ মিসরকে সা'ঈদ' বলা হতো। ইবনে আবি-সারহ, এর গভর্নর ছিলেন। উক্ত প্রদেশে মোট ২৮টি জেলা ছিল। নিম্ন মিসরের গভর্নর ছিলেন আমর ইবনুল 'আস। উক্ত প্রদেশ ১৫টি জেলায় বিভক্ত ছিল। সমগ্র পারস্য সাম্রাজ্যকে একটি একক অঞ্চল ধরে প্রশাসনিক কার্য চালান হতো। কিন্তু প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পারস্যে সাসানী আমলের ৬টি প্রদেশ হুবহু রেখে দেয়া হয়।
খোলাফায়ে রাশেদূনের শাসনকালে খিলাফাতের শাসন কাঠামো একটি নবরূপ লাভ করে। প্রদেশিক শাসন ব্যবস্থাও একটি নির্দিষ্ট রূপরেখার আওতায় পরিচালিত হয়। খোলাফায় রাশেদূনের আমলে প্রত্যেক প্রদেশের রাজধানীতে একটি স্থায়ী সরকারী অফিস ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রত্যেকটি প্রাদেশিক ওয়ালীর একটি করে দীওয়ান বা সেক্রেটারীয়েট (Secretariat) স্থায়ীভাবে স্থাপিত হয়। খলীফা উমর (রা) যখন 'আম্মারকে কুফার ওয়ালী হিসেবে প্রেরণ করেন তখন তাঁর সাথে দশজন বিশ্বস্ত ও উপযুক্ত কর্মচারীও প্রেরণ করেন। প্রদেশের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ওয়ালী বা গভর্নর, আমিল বা জেলা প্রশাসক, কাযী বা বিচারক, কাতিব আল-দীওয়ান বা সচিব এবং সাহিব বায়তুলমাল বা কোষাধ্যক্ষ।
প্রশাসনিক সুবিধার জন্য প্রত্যেকটি প্রদেশ আবার কতগুলো জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলা প্রশাসককে আল-আমিল বলা হতো। বড় বড় জেলাকে কতগুলো অঞ্চলে (sub-divisions) sions) বিভক্ত করা হয় এবং উক্ত অঞ্চলে পৃথক আমিল নিযুক্ত করা হয়। জেলায় জেলায় বিচারের জন্য কাযী নিযুক্ত করা হতো। জেলা বা আঞ্চলিক শাসকগণ ওয়ালীর অধীনে ছিলেন।
খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে ওয়ালী কিংবা আমিল ইত্যাদি কর্মচারীর নিযুক্তির সময় তাঁর সম্পত্তির হিসেব নেয়া হতো। অতঃপর তাঁকে নিয়োগপত্র প্রদান করা হতো। নিয়োগপত্রে উক্ত কর্মচারীর দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং ক্ষমতার পরিধি উল্লেখ থাকত। খলীফার স্বাক্ষর ও সীলমোহরকৃত উক্ত নিযুক্তি পত্রে কয়েকজন গণ্যমান্য আনসার ও মুহাজির ব্যক্তি স্বাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করতেন এবং মসজিদে সাধারণ নাগরিকদের সম্মুখে উক্ত নিয়োগনামা পাঠ করে শোনান হতো। ইমাম আবু ইউসুফ (র) বলেন, খলীফা উমর (রা) ওয়ালীদের নিম্নলিখিতভাবে পরামর্শ দিতেন।
"আপনারা জেনে রাখুন যে, আমি আপনাদেরকে শাসক বা রাজা হিসেবে প্রেরণ করছি না। আমি আপনাদেরকে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করছি। জনসাধারণ আপনাদের অনুসরণ করবে। ভাল লোকদের উপর বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পণ করবেন। তাদেরকে এমন আঘাত দিবেন না যাতে তারা অপমানিত হয় বা তাদের এমন প্রশংসাও করবেন না যাতে তারা শৃংখলা ভঙ্গ করে। আপনার দরজা জনসাধারণের জন্য মুক্ত রাখবেন। তা না হলে সবলরা দুর্বলদের উপর অত্যাচার করবে।
আরো পড়ুন: মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স)-এর জীবনাদর্শ
বেতন ভাতা
প্রশাসকগণ সকলেই নিয়মিত বেতনসহ রেশন পেত। বেতনের পরিমাণও ছিল উচ্চ। আম্মার ইবন ইয়াসির বার্ষিক ৬০০ দিরহাম এবং দৈনিক রেশন পেতেন। কর্মচারীদের কার্যকলাপের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা হতো। অবৈধ উপায়ে ধন সংগ্রহ বা সঞ্চয়ের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। দুর্নীতির অভিযোগে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো।
বিচার বিভাগ
খোলাফায়ে রাশেদুন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা এবং নিরপেক্ষ রাখার দিক দিয়ে সকল যুগের উপর শ্রেষ্টত্ব লাভ করেন। তাঁরা নিরপেক্ষ বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগকে উৎসাহ প্রদান করেন। খোলাফায়ে রাশেদুনের আমলে বিচার বিভাগ দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিচারে শুনানী ও রায়দানের বিধি বিধান সুষ্ঠু নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
বিচারের গুরু দায়িত্ব যে ব্যক্তির উপর ন্যস্ত হতো তাকে কাযী বলা হতো। কেন্দ্রে খলীফা স্বয়ং প্রধান কার্যীর দায়িত্ব পালন করতেন। প্রাদেশিক কাযী এবং জেলা-কাযী নিযুক্ত হতেন। কাযীগণ প্রাদেশিক গভর্নর বা জেলা প্রশাসকের অধীন ছিলেন না বরং তাঁরা ছিলেন পূর্ণ স্বাধীন। কাষীদেরকে খলীফা স্বয়ং নিযুক্ত করতেন। কখনও বা খলীফার আদেশে প্রাদেশিক গভর্নরগণ ন্যায়বান ব্যক্তিকে কাযী হিসেবে নিযুক্ত করতেন। খলীফা উমর (র) আবু মুসা আল-আশয়ারীকে (র) জনগণ কর্তৃক সম্মানিত ব্যক্তিকে কার্যী নিয়োগ প্রদান করতে আদেশ প্রদান করেন। কার্যীগণ উচ্চ নীচ ভেদাভেদ না করে বিচারের রায় প্রদান করতেন। এমনকি হযরত আলী (রা) ও একবার কাযীর বিচারে হেরে যান।
কাযীদের আবশ্যকীয় যোগ্যতা ও গুণাবলী
নিযুক্তির সময় কার্যীর যোগ্যতা চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করে দেখা হতো। কাযীকে যে সব অপরিহার্য গুণের অধিকারী হতে হতো সেগুলো হচ্ছে
• তাঁকে পবিত্র কুরআন সম্বন্ধে সুপন্ডিত হতে হতো।
• তাঁকে হাদীসশাস্ত্রে পূর্ণজ্ঞানের অধিকারী হতে হতো।
• তাঁকে সাহাবীদের পদ্ধতি সম্বন্ধে জ্ঞানের অধিকারী হতে হতো।
• তাঁকে পূর্ণ বয়স্ক, পুরুষ, মুসলমান, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন, স্বাধীন, সচ্চরিত্র, দৃষ্টিশক্তি ও পূর্ণ শ্রবণশক্তি সম্পন্ন হতে হতো।
কাযীগণ এমন চারিত্রিক মাধুর্য ও উন্নত গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন যে, খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে কোন কাযীর বিরুদ্ধে উৎকোচ গ্রহণ বা পক্ষপাতমূলক বিচারের অভিযোগ উত্থাপিত হয় নি। খোলাফায়ে রাশেদুন সরকার কাযীদেরকে উপযুক্ত বেতন প্রদান করতেন।
আরো পড়ুন: হযরত সোলায়মান (আ) এর জীবনী
কাযীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য
কাযীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল বিবাহ সংক্রা সমস্যা নিষ্পত্তি করা, অধিকার পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা, ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করা, অছিয়ত কার্যকর করা, বিধবা বিবাহ উৎসাহিতো ও বন্দোবস্ত করা, অপরাধিদের নির্ধারিত শাস্তি প্রদান করা, অনধিকার দখল উচ্ছেদ করা, ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনস্থদের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাখা এবং তাদের আচরণের উপর লক্ষ্য রাখা। দুর্বলকে সবলদের অত্যাচার ও অন্যায় থেকে রক্ষা করা।
বিচারের সময় কাযীদের করণীয়
খোলাফায়ে রাশেদুন সরকার আমলে কাযীদের করণীয় ছিল নিম্নরূপঃ
• বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষকে সমভাবে গ্রহণ করা,
• বাদী ও বিবাদী উভয়কেই প্রমাণ উপস্থাপন করার সুযোগ দেয়া,
সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে বাদী ও বিবাদী উভয়কেই প্রতিজ্ঞা পত্র পাঠ করানো,
• যে কোন অবস্থায় বাদী ও বিবাদীর মধ্যে কাযীর মামলা নিষ্পত্তি করা,
• বিচারক কর্তৃক স্বেচ্ছায় ইচ্ছায় নিজ রায় পুনর্বিবেচনা করা,
• বিচারের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা,
• বিবাদীর অনুপস্থিতিতে এক তরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা,
• যে সব মুসলমান কোন বিচারে শাস্তিপ্রাপ্ত হন নি বা মিথ্যা সাক্ষা প্রদান করেন নি শুধু তাদেরকেই সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য প্রদানের যোগ্য বলে বিবেচিত করা।
তখন বিচারালয় হিসেবে মসজিদকে ব্যবহার করা হতো। বিচারের দিন উভয় পক্ষ স্ব স্ব লোক নিয়ে বিচারালয়ে উপস্থিত হতো। সাধারণ লোকেরা দর্শক হিসেবে বিচার শ্রবণ করতে উপস্থিত হতো।
বাদী ও বিবাদীকে আইন সম্বন্ধে পরামর্শ প্রদানের জন্য খলীফাগণ সরকারীভাবে কতিপয় আইন বিশেষজ্ঞ (মুফতি) নিযুক্ত করতেন। কাযীগণও আইনের জটিল সমস্যা সম্বন্ধে মুফতিদের নিকট হতে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারতেন। পরামর্শ প্রদানের জন্য মুফতিগণ কোন ফি গ্রহণ করতে পারতেন না।
খোলাফায়ে রাশেদূনের মধ্যে হযরত উমর (রা) বিচারের জন্য কাযীকে বিশেষভাবে স্বাধীনতা প্রদান করেন। বিখ্যাত কাযী শুরাইহা শুরাইহকে প্রথমতঃ পবিত্র কুরআনের বিধি অনুসারে বিচারের পরামর্শ দেন। দ্বিতীয়তঃ হাদীসের উপর নির্ভর করে বিচারের রায় প্রদানের জন্য তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। হাদীসে অনুরূপ দৃষ্টান্ত না পাওয়া গেলে ইজমা'র আদর্শ অনুসরণ করতে তিনি আদেশ দেন। ইজমা' দ্বারা অনুরূপ ব্যাপারে নিষ্পত্তির দৃষ্টান্ত না থাকলে তিনি শুরাইহকে নিজ মত প্রয়োগ করার অধিকার প্রদান করেন। জটিল ব্যাপারগুলো নিষ্পত্তি করার জন্য তিনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করতে আদেশ প্রদান করেন।
খলীফা উমর দোষীকে কারারুদ্ধ করার জন্য সর্ব প্রথম কারাগারের ব্যবস্থা করেন। তিনি সাফাওয়ান ইবন উমাইয়ার গৃহ ক্রয় করে মক্কায় কারাগার প্রতিষ্ঠা করেন। অনুরূপভাবে প্রাদেশিক রাজধানীগুলোতেও কারাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিনি নির্বাসন দন্ড প্রদানের রীতিরও প্রচলন করেন।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url