ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের গুণাবলী

 ইসলামি রাষ্ট্রের মজলিসে শূরার গুরুত্ব বর্ণনা কতে পারবেন। ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান-এর গুণাবলী সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন। কারা মুসলিম জনগণের নেতা হতে পারবেন না তাদের সম্পর্কে বলতে পারবেন।

ভূমিকা 

ইসলামি শরীআত মোতাবেক গঠিত ও পরিচালিত রাষ্ট্রই ইসলামি রাষ্ট্র। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকারী সর্বশক্তিমান আল্লাহ। রাষ্ট্রপ্রধান আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি মাত্র। তাই ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান-এর গুরুত্ব ও ভূমিকা অন্যান্য সাধারণ রাষ্ট্রের চেয়ে স্বতন্ত্র এবং ভিন্ন প্রকৃতির। যাবতীয় সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর নির্ভর ও বিশ্বাস স্থাপন করে তার আনুগত্য ও অনুসরণ করা মুসলমানদের জন্য ফরয। এ কারণেই রাষ্ট্রপ্রধান-এর মধ্যে কতকগুলো আইনগত এবং চারিত্রিক গুণ-বৈশিষ্ট্য থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। আর যার মধ্যে এ সকল গুণ-বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান থাকবে, জনগণ তাকেই আমীর বা রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত করে রাষ্ট্র পরিচালনার গুরু দায়িত্ব অর্পণ করবে। তিনি জনগণের রায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সর্বাধিক যোগ্য ও নীতিবান ব্যক্তিবর্গকে মজলিসে শূরার সদস্য নির্বাচিত করবেন। আর তাদের পরামর্শক্রমে শরীআত মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন।


রাষ্ট্রপ্রধান-এর আইনগত গুণাবলী

ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান-এর নিম্নবর্ণিত আইনগত গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে।

মুসলিম হওয়া: ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। কোন অমুসলিম ইসলামি রাষ্ট্রের এ পদের উপযুক্ত নয়। 

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহর ঘোষণাঃ

"হে মুমিনগণ। তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতার অধিকারী।" (সূরা আন-নিসা ৫৯)


এখানে তোমাদের মধ্য হতে, কথাটি প্রমাণ করে তাকে মুসলিম হতে হবে।

পুরুষ হওয়া: রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে। কোন মহিলা ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবে


না। মহানবী (সা)-এ মর্মে বলেন-

"যে জাতি কোন মহিলাকে তাদের নেতৃত্বে বরণ করে, সে জাতি কখনো সফলতা অর্জন করতে পারবে না।" এ সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষণা-

"পরুষ নারীর কর্তা।" (সূরা আন-নিসা। ৩৪)


প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া: উক্ত পদের জন্য অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক কেউ রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারবে


সুস্থ হওয়াঃ অসুস্থ ও শারীরিক দিক দিয়ে অক্ষম ব্যক্তি ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান পদের জন্য উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত নয়।

বোধশক্তি সম্পন্ন হওয়াঃ উক্ত গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য বোধশক্তি সম্পন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিবেক-বুদ্ধিহীন, পাগল ও নির্বোধ লোককে ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান করা যাবে না। কুরআন বলছে-

"তোমাদের সম্পদ নির্বোধ লোকদের হাতে অর্পন করো না।" (সূরা আন-নিসা। ৫)


স্থায়ী অধিবাসী হওয়াঃ ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান রাষ্ট্রের স্থায়ী অধিবাসী হবেন। অস্থায়ী কোন বাসিন্দাকে রাষ্ট্রের প্রধান করা যাবে না।


রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়াঃ ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হতে হলে, অবশ্যই তাকে রাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে। নাগরিকত্বহীন ব্যক্তি এ পদের উপযুক্ত নন। এ মর্মে মহান আল্লাহর বাণী- 'যারা ঈমান এনেছে অথচ হিজরত করে ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিক হয়নি, হিজরত করে নাগরিক না হওয়া পর্যন্ত ওয়ালী বা নেতৃত্বের কোন অধিকার তাদের নেই।"


চারিত্রিক ও নৈতিক গুণাবলী সম্পন্ন হওয়া

ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হতে হলে আইনগত গুণাবলীর পাশাপাশি কতিপয় নৈতিক ও চারিত্রিক গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া একান্ত অপরিহার্য। যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো।


তাকওয়ার ও নৈতিকতার অধিকারী হওয়া: রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য ব্যক্তিকে তাকওয়ার অধিকারী, আল্লাহভীরু ও পরহেযগার লোক হতে হবে। আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন-

"তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী।" (সূরা আল-হুজুরাত ১৩)


আমানতদার ও আস্থাভাজন হওয়া: রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার জন্য সততার অধিকারী, আমানতদার ও জনগণের আস্থাভাজন হতে হবে। বিশ্বাসঘাতক, খিয়ানতকারী কখনও উক্ত পদের উপযুক্ত নয়। এ মর্মে আল্লাহর বাণী-

"নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন আমানতসমূহ তাদের প্রাপকদের কাছে পৌছে দিতে।" (সূরা আন-নিসা: ৫৮)


বিচক্ষণ ও প্রজ্ঞাবান হওয়া: এ পদের জন্য বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিবৃত্তি, উদ্ভাবনী ও বিশ্লেষণ শক্তি, গভীর জ্ঞান প্রভৃতি গুণের অধিকারী হওয়া আবশ্যক। নচেৎ রাষ্ট্রীয় জটিলতা ও সমস্যামূলক কার্যাবলী সমাধান করা এবং ইসলামি রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। হাদীসে এসেছে-

"যখন অযোগ্য লোককে দায়িত্বপূর্ণ পদে বসানো করা হয় তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করবে"। (বুখারী ইলম অধ্যায়)


জ্ঞানের পাশাপাশি শারীরিক যোগ্যতা: রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার জন্য দৈহিক ক্ষমতা সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। স্বাস্থ্যবান মানুষ ছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। এ কারণেই উক্ত পদের জন্য স্বাস্থ্যবান হওয়া বাঞ্ছনীয়। এ মর্মে মহান আল্লাহর ঘোষণা-

"তিনি তাকে জানে ও দেহে সমৃদ্ধ করেছেন।" (সূরা আল-বাকারা ২৪৭)


পদলোভী না হওয়া: ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান যেহেতু সমাজের শ্রেষ্ঠ নৈতিক আদর্শের অধিকারী বলে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হবেন, তাই কেউ এখানে পদপ্রার্থী বা পদলোভী হতে পারবে না। নির্বাচনে পদপ্রার্থী হওয়া, তদ্বির, প্রচার ও অর্থ ব্যয় করা এ পদের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। কেননা জনগণই নৈতিক মান দেখে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত করবেন। মহানবী (স) এ প্রসঙ্গে বলেন- "আল্লাহর শপথ। এমন কাউকে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করা যাবে না, যে ব্যক্তি নিজেই তা চায় বা এর জন্য লালায়িত হয়।"


অর্থলোভী না হওয়া: রাষ্ট্রপ্রধান-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদের যোগা হওয়ার জন্য তাকে অবশ্যই অর্থ-সম্পদের প্রতি লোভহীন হতে হবে। অর্থের প্রতি মোহ থাকলে এ পদে তাকে নির্বাচিত করা যাবে না। কারণ এ লোভের কারণে সে রাষ্ট্রীয় সম্পদের তসরূপ করতে পারে।


আল্লাহকে সর্বদা স্মরণকারী হওয়াঃ এ দায়িত্বপূর্ণ পদের জন্য অবশ্য আল্লাহকে সদা স্মরণকারী হওয়া আবশ্যক। কখনও তার হৃদয় আল্লাহর স্মরণশূন্য হতে পারবে না। কেননা আল্লাহর স্মরণশূন্য হৃদয় যার, তার দ্বারা যে কোন অন্যায়, অনাচার হতে পারে। এ সম্পর্কে আল্লাহর হুশিয়ারী-

"তুমি তার আনুগত্য করোনা -যার চিত্তকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি।" (সূত্র আল-কাহাফ ২৮)


বিদআতপন্থী না হওয়া: রাষ্ট্র পরিচালনার মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ পদে রাসূলের সুন্নাহ পরিপন্থী কোন বিদআতী বা কুসংস্কার পন্থী কোন ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা যাবে না। কেননা এ জাতীয় লোক দ্বারা কখনো ইসলাম বা মানবতার কল্যাণ সাধিত হতে পারে না। বরং ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। মহানবী (স) ডাই বলেছেন, "ইসলামের নামে সকল কুসংস্কার পথ ভ্রষ্টতা হিসেবে গণ্য।"

ন্যায়বিচারক হওয়া: সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে ন্যায়বিচার একটি অপরিহার্য শর্ত। তাই ইসলামি রাষ্ট্রের পরিচালক বা রাষ্ট্রপ্রধানকে অবশ্যই ন্যায়বিচারক হতে হবে। মহান আল্লাহর ঘোষণা-


"তোমরা যখন মানুষের মাঝে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায় পরায়ণতার সাথে বিচার করবে।" (সূরা আন-নিসা ৫৮)


রাষ্ট্রীয় দায়িত্বসমূহ উত্তমভাবে পালনের যোগ্যতা ও প্রতিভা: প্রশাসনিক কর্তব্য ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সুচারুরূপে পালনের জন্য তার স্বভাবগত যোগ্যতা একান্তই অপরিহার্য। নেতৃত্বদান ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের জন্য মৌলিক শর্ত হচ্ছে, প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ মানের যোগ্যতা। কেননা মানুষের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে. প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শাসকদের অযোগ্যতা ও অনুপযুক্ততা বিশ্ব জাতিসমূহের বিশেষ করে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ব্যাপক ও মারাত্মক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করছে, জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে চরম দুর্গতি ও দুর্ভোগ। প্রশাসকের এই গুণ থাকার শর্তটির গুরুত্ব ও অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। তা প্রমাণের জন্য কোন দলীল পেশ করার প্রয়োজন পড়ে না। নেতৃত্ব স্বতঃই এই শর্তের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে। নবী কারীম (স) নিজে এই শর্তের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা প্রসঙ্গে বলেন-

"নেতৃত্বদানের জন্য কেবল সেই পুরুষই উপযোগী যার মধ্যে এ তিনটি স্বভাব রয়েছে-


  • এমন আল্লাহ ভীতি যা তাকে আল্লাহর নাফরমানীর কাজ থেকে বিরত রাখে।
  • এমন ধৈর্য-সহ্য যা দ্বারা সে তার ক্রোধ আয়ত্তে রাখতে পারে।
  • সে যাদের নেতৃত্ব দেবে তাদের উপর উত্তম নেতৃত্ব দান করবে যেন তারা সবাই তার সন্তান তুল্য হয়ে যায়।"


মুসলিম জনগণের নেতা এমন ব্যক্তি হতে পারেন- যিনি উদারতা, সহনশীলতা ও নৈতিক গুণাবলীর অধিকারী হবেন।

বস্তুও উপরোক্ত আলোচনা হতে বুঝা যায় যে, ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান সেই রাষ্ট্রেরই একজন সুস্থ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন আদর্শ জনদরদী সুপুরুষ এবং খোদাভীরু, আমানতদার, সুবিচারক ও নিঃস্বার্থবাদী মানুষ হতে হবে। অর্থাৎ উপরোক্ত গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তিই ইসলামি রাষ্ট্রের কর্ণধার হওয়ার উপযুক্ত। তার আনুগতা সানন্দে স্বীকার করতঃ সর্বাবস্থায় তারা আনুগত্য করা সকলের উপর ফরয। আর এটাই হলো একটি আদর্শ ইসলামি রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url