ইসলামি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো
মদীনা সনদের সারসংক্ষেপ সম্পর্কে লিখতে পারবেন। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক বিভাগসমূহ সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন। ইসলামি রাষ্ট্রের অর্থবিভাগ সম্পর্কে বলতে পারবেন, ইসলামি রাষ্ট্রের সমর এবং শিক্ষা বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে মহানবী (স.)-এর অবদান সর্বজনবিদিত। তিনি মানব জাতির একমাত্র ও সর্বশ্রেষ্ঠ অনুকরণীয় আদর্শ। আরবরা ছিল তখন শতধা বিভক্ত। মহানবী (স.) মদীনায় হিজরত করে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতির ভাব সৃষ্টির প্রয়াস পান। তিনি মদীনা সনদ উপহার দিয়ে জাতিকে সংঘবদ্ধ করেন। এ সনদের উপর ভিত্তি করেই ইসলামি রাষ্ট্রের বুনিয়াদ রচিত হয়। এ রাষ্ট্রের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে সমগ্র বিশ্বে ইসলামের কালজয়ী আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে। এ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন স্বয়ং তিনি। তাঁর প্রশাসন ছিল আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের নিকট একান্ত বিজ্ঞানসম্মত ও যুগোপযোগী। তাঁর প্রশাসন সম্পর্কিত একটি বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো।
মদীনার সনদের সারসংক্ষেপ
হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর প্রতিষ্ঠিত মদীনায় ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্রের রূপরেখা তুলে ধরতে হলে মদীনার সনদ সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা জরুরি।
ক. মদীনার আনসার, মুহাজির, খৃষ্টান, ইয়াহুদী এবং তাদের মাওয়ালী ও মিত্রবর্গ সকলে মিলে একটি অখত জাতি (উম্মাহ) বলে পরিগণিত হবে। এই রাষ্ট্রে সকলের জন্য সমানাধিকার স্বীকৃত। আবার দুশমনের হামলা থেকে মদীনা রাষ্ট্রকে রক্ষা করার দায়িত্বও সকলের উপর বর্তাবে। যুদ্ধের সময় প্রত্যেকে স্ব-স্ব ব্যয়ভার নির্বাহ করবে। সনদের অংগীভূত সকল জাতি নির্বিঘ্নে স্ব-স্ব ধর্ম পালন করবে।
খ. উম্মাহভুক্ত কেউ নবী করীম (স) -এর অনুমতি ব্যতিরেকে কোন যুদ্ধে গমন করতে পারবে না। আল্লাহতে বিশ্বাসীগণ ব্যতীত অন্য কারো সংগে কেউ পৃথক চুক্তি সম্পাদন করতে পারবে না এবং মদীনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না। মদীনা আক্রান্ত হলে সকলেই সমভাবে প্রতিরোধ করবে।
গ. মদীনায় বসবাসরত ইয়াহুদীরাও মুসলমানদের সাথে এক জাতি হিসেবে গণ্য। যতদিন তারা মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করে বা ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না হয় ততদিন তারা সমানাধিকার ও মর্যাদা ভোগ করবে।
ঘ. যুদ্ধ বা শান্তি উভয় ক্ষেত্রেই মদীনায় রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর নেতৃত্ব ও সর্বময় কর্তৃত্ব স্বীকৃত।
ঙ. বিচারব্যবস্থায় মহানবীর সর্বময় কর্তৃত্ব ঘোষণা করা হয় এবং নিজেদের মধ্যে যে কোন বিবাদ বিসম্বাদের মীমাংসার দায়িত্ব তাঁর উপর সোপর্দ করা হয়।
চ. মক্কার কুরায়শরা সাধারণভাবে মদীনা রাষ্ট্রের পকাশ্য দুশমন। তাদেরকে বা তাদের মিত্রদেরকে সহায়তা করতে নিষেধ করা হয়।
ছ. সনদে আরও বলা হয় যে, প্রত্যেকটি গোত্র সামগ্রিকভাবে হযরত মুহাম্মদ (স)-এর সার্বভৌম ক্ষমতা ও নেতৃত্ব মেনে চলবে। তবে স্ব-স্ব গোত্রপতিদের গোত্রীয় প্রাধান্যও অক্ষন্ন থাকবে। প্রত্যেকটি গোত্র তাদের পূর্ববর্তী চুক্তিপত্র এবং দেয় 'মৃত্যুপণ' ও 'মুক্তিপণ'সমূহ এককভাবে প্রদান করবে। সেখানে রাষ্ট্র কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না।
রাষ্ট্রীয় প্রধান
মহানবী (স) তাঁর প্রদত্ত সনদের আলোকে মদীনা রাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতির মর্যাদায় ভূষিত হন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলেই তাঁকে সরকার প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সকলের সমান নাগরিক অধিকার ও মৌলিক অধিকার পূর্ণ মাত্রায় প্রদান করেন।
ইসলামি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক বিভাগসমূহ
সরকার পরিচালনার কোন আদর্শ তাঁর সামনে ছিলো না। তিনি তাঁর অপরিসীম প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও প্রখর বুদ্ধি বলে মদীনার মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে একটি সচিবালয় সদৃশ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলেন। পৃথিবীর রাষ্ট্র দর্শনের ইতিহাসে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সরকার একটি অনুপম দৃষ্টন্ত হয়ে রয়েছে। মদীনার এই রাষ্ট্রটি ছিলো মানব সভ্যতার ইতিহাসের সর্বোত্তম জনকল্যাণমূলক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত। এর ছিল বিভিন্ন দফতর ও বিভাগ। দফতর ও বিভাগগুলো ছিলো নিম্নরূপ:
রাষ্ট্রপ্রধানের ব্যক্তিগত বিভাগ: বিশ্বনবী (স) ছিলেন মদীনার ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্রের মহানায়ক। হযরত হানযালা ইবনে আর-রাবী (রা.) ছিলেন রসূল করীম (স)-এর একান্ত সচিব। তিনি রাসূলুল্লাহ (স)-এর সীল সংরক্ষণ করতেন।
ওহী লিখন বিভাগ: এই দফতরের সাথে সংশ্লিষ্টদের 'কাতিব' বলা হতো। হযরত আলী (রা.) ও হযরত উসমান (রা.) মূল ওহী লেখক ছিলেন। তাঁদের অনুপস্থিতিতে হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.) এবং হযরত যায়দ ইবনে সাবিত (রা.) ওহী লেখার কাজে নিয়োজিত হতেন। হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রা.) ওহী লেখকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
দাওয়া বিভাগ: এ বিভাগটি সম্পূর্ণরূপে রসূল (স)-এর নিয়ন্ত্রণে ছিলো। তিনি স্বয়ং প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রচারকদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের নিকট প্রেরণ করতেন। আল্লাহর যমীনে তাঁর দীন প্রতিষ্ঠার আহবান জানানো ছিলো প্রচারকদের মূল কাজ। এছাড়া যাঁরা ইসলামের সুশীতল নীড়ে আশ্রয় নিতেন তাদেরকে ইসলামের বিধি-বিধান শিক্ষা দেয়া, তাঁদের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাও প্রচারকদের অন্যতম দায়িত্ব ছিলো।
পত্র লিখন ও অনুবাদ বিভাগ: রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাসূল (স)-এর বিভিন্ন ফরমান, বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে প্রেরিত চিঠি লিখন, প্রাপ্ত তথ্যাবলী এবং চিঠি পত্রাদি অনুবাদ করা ছিল এই বিভাগের দায়িত্ব। যায়দ ইবনে সাবিত (রা.) এবং আবদুল্লাহ ইবনে আরকাম (রা.) এই বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন বিভাগ: বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের মধ্যে সমঝোতামূলক যোগসূত্র স্থাপন ও তাদের সাথে সৌহার্দ্যমূলক আচরণ সম্পর্কীয় কার্যাবলীর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন হযরত মুগীরা ইবনে শু'বা ও হাসান ইবনে নুমায়র (রা)।
অভ্যর্থনা বিভাগ: রাসূল করীম সা.-এর দরবারে সর্বদা সাক্ষাৎ প্রার্থীদের ভীড় লেগে থাকতো। এঁদের অভ্যর্থনা ও সৌজন্য সাক্ষাতের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) এবং হযরত
বারা ইবনে আযিব (রা)।
নিরাপত্তা (পুলিশ) বিভাগ: নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য কোন পুলিশবাহিনী ছিলো না। তবে একদল নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবী সাহাবী নিরাপত্তা ও প্রহরার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এই বিভাগকে আশ-শুরতা বলা হতো। হযরত কায়স ইবনে সা'দ (রা.) এ বিভাগের প্রধান ছিলেন।
প্রতিরক্ষা বিভাগঃ রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার স্বার্থে ইসলামি বিপ্লবের সংঘাতময় পর্ব উত্তরণের জন্য রাসুল (সা) প্রতিটি মুসলমানকে সুদক্ষ সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। মদীনা রাষ্ট্রে কোন বেতনভোগী সেনাবাহিনী ছিলো না। প্রয়োজনে প্রত্যেক সক্ষম মুসলমানই মুজাহিদ হিসেবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রণাঙ্গণে উপস্থিত হতেন। মহানবী (স) স্বয়ং ছিলেন প্রতিরক্ষা বিভাগের সর্বাধিনায়ক। সৈন্যগণ ছিলেন পদাতিক, অশ্বারোহী, তীরন্দাজ ও বর্মধারী।
সমরাস্ত্র নির্মাণ বিভাগঃ আল্লাহদ্রোহীদের সাথে মুকাবিলার জন্য যুগোপযোগী সমরাস্ত্র নির্মাণ পরিকল্পনা ছিলো মহানবীর সামরিক কলাকৌশলের একটি অনন্য দিক। তরবারি, তীর, ধনুক, ঢাল, বল্লম, মিনজানিক (ক্ষেপণাস্ত্র) ইত্যাদি জরুরী যুদ্ধাস্ত্র তৈরী ও সংরক্ষণ কার্যাদি এ বিভাগের আওতাধীন ছিল। হযরত সালমান আল-ফারসী (রা) ছিলেন রাসু করীম (স.)-এর সামরিক উপদেষ্টা।
বিচার বিভাগ: রাষ্ট্র ও ধর্ম বিষয়ের প্রধান হিসেবে রাসূল (স.) বিচার বিভাগেরও প্রধান ছিলেন। হযরত আলী (রা) এবং মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.) প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ বিচারকার্যও সম্পাদন করতেন।
হিসাব সংরক্ষণ বিভাগঃ জাতীয় আয় ও ব্যয়ের সঠিক হিসাব সংরক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন হযরত মুয়াইকীব ইবনে আবি ফাতিমা (রা)। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন।
যাকাত ও সাদকাহ বিভাগ: যাকাত ও সাদকাহসহ যেসব সম্পদ ও অর্থকড়ি সংগৃহীত হতো সেগুলোর হিসেব সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) ও যুহাইর ইবনে আস-সালতা (রা.)-এর উপর। তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট সততা ও নিষ্ঠার পরিচয় প্রদান করেছিলে।
খেজুর বৃক্ষের কর আদায় বিভাগ: মদীনা রাষ্ট্রে প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য ছিল খুরমা-খেজুর। মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ খেজুর কর হিসেবে রাজকোষে আসতো। হযরত হুযায়ফা ইবনে আল-ইয়ামান (রা.) ছিলেন এই বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত।
আদম শুমারী বিভাগ: বিভিন্ন গোত্র এবং তাদের জলাশয়, আনসার, মুহাজির, পুরুষ ও মহিলাদের হিসাব সংরক্ষণ করতেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আরকাম (রা.) এবং হযরত আলা ইবনে উকবা (রা.)।
নগর প্রশাসন বিভাগ: হযরত উমর ফারুক (র.) এ বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁর এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেন।
নগর উন্নয়ন ও প্রকৌশল বিভাগ: গণপূর্ত ও নগর উন্নয়নের ভিত্তি এ সময়ে রচিত হয়। ঘরবাড়ী তৈরীর নকশা ও প্ল্যান তৈরীর কাজ শুরু হয়। মিনার ও মসজিদে নববীর স্থাপত্য কৌশলের পূর্বাভাস রসূল (স.)-এর যুগেই হয়েছিল। ইবনে সাদ তাঁর তাবাকাতে লিখেছেন, সে সময় রাসূল (স.) যে জমির উপর বাড়ীর স্থান নির্ধারণ করেছিলেন অদ্যাবধি হযরত উসমান (রা.)-এর বাড়ী সে স্থানেই বিদ্যমান রয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ: মদীনা রাষ্ট্রের জনসাধারণ বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা লাভ করতেন। হারিস ইবনে সালাহ তৎকালে প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসকগণ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা পেতেন। জনসাধারণের স্বাস্থ্য সংরক্ষণের জন্য মহানবী (স.) পরিস্কার-পরিচছন্নতা ও পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আদেশ-নিষেধ জারি করেন।
এভাবে মহানবী (স.) প্রতিষ্ঠিত নবীন ইসলামি রাষ্ট্রে একটি বহুমুখী কার্যাবলী আনজাম দেওয়ায় সুষ্ঠু নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছিল।
পররাষ্ট্র বিভাগ
পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক সমঝোতা, মৈত্রীবন্ধনে উদারতা এবং শত্রুর প্রতি ক্ষমা সুন্দর মনোভাব পোষণ ছিলো রাসূলে করীম (স)-এর পরাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য। চরম শত্রুর প্রতিও ক্ষমাসুন্দর ও বন্ধুত্বপূর্ণ ঔদার্য প্রদর্শন করা ছিলো তাঁর নীতি। মক্কা বিজয়ের পর মক্কাবাসীদেরকে তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা করেন এবং তায়েফের অত্যাচারী সম্প্রদায়কে ক্ষমা ও তাদের জন্য আল্লাহর দরবারে রহমত কামনার মাধ্যমে তিনি অনুপম কুটনৈতিক মহানুভবতার পরিচয় দেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে মক্কাবাসীদের বহু শর্তকে নির্দ্বিধায় মেনে নিয়ে এই চুক্তির প্রতি অবিচল থেকে কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শুধু হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তিই নয়, অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে সম্পাদিত বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক কিংবা ত্রিপাক্ষিক চুক্তিসমূহের শর্ত প্রতিপালনে তিনি যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় দিতেন। উম্মী নবী (স.)-এর পক্ষে লিখিত এসব চুক্তি ও দলীলের আক্ষরিক বিধানের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা প্রদর্শন এক বিস্ময়কর ব্যাপার বৈ কি।
অর্থ বিভাগ
রাষ্ট্রনায়ক নবী করীম (স) রাষ্ট্রীয় জীবনে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ রাষ্ট্রের প্রশাসনে ও সামরিক ব্যয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সংগ্রহ এবং রাষ্ট্রের গরীব নাগরিকদের ভরণ-পোষণ ও পুনর্বাসনের জন্য এক সুসংহত অর্থ ব্যবস্থা কায়েম করেন।
ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিভাগ
ভূমি সংস্কার প্রসঙ্গেও নবী করীম (স)-এর সুস্পষ্ট নীতি ছিলো। যে ব্যক্তি পতিত ভূমিকে আবাদ করবে, সে তার মালিক হবে। যে ব্যক্তি কোন ভূমিকে প্রাচীর দ্বারা ঘিরে নেবে তা তার মালিকানায় চলে যাবে। জমি বর্গা চাষের বিধান ছিল। চাষাবাদের শর্তে রাষ্ট্রীয় খাস জমি বন্দোবস্ত বা জায়গীর হিসেবে দেওয়া হতো।
সামরিক প্রশাসন
সময়ের স্বল্পতা ও বিভিন্ন কর্মকান্ডে স্ব-স্ব ব্যস্ততার দরুন মহানবী (স.) নিয়মিত সেনা সংগঠন গড়ে তুলতে পারেন নি। তবে সাহাবা কিরাম তাঁর নির্দেশের প্রতি এতই আস্থাশীল ছিলেন যে, হাসিমুখে জীবন উৎসর্গ করতেন। জিহাদে অংশ গ্রহণ করাকে তাঁরা গৌরবজনক বিষয় বলে জানতেন। এমন কি যুদ্ধের ময়দানে বাছাই পর্বে বৃদ্ধাঙ্গুলীর উপর ভর করে দাঁড়িয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য তারা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়তেন। বয়সে ছোটরা রাসুল (স)-এর সামনে পরস্পর কুস্তি ও দ্বন্দ্ব যুদ্ধের পরামর্শ করে হারজিতের নমুনা প্রদর্শন করে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য সম্মতি লাভ করতো। প্রয়োজনের সময় রাসূল (স) পুরো জাতিকে তলব করতেন। তাঁরা পঙ্গপালের ন্যায় ছুটে এসে সেই আহবানে সাড়া দিতেন।
সাতাশটি যুদ্ধে মহানবী (স.) স্বয়ং প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অন্যান্য যুদ্ধে এক একজন প্রতিনিধিকে সেনাপতির দায়িত্ব প্রদান করে প্রেরণ করতেন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে রাষ্ট্রের অখন্ডতা ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য তিনি যুদ্ধ করতে বাধ্য হন। এর কোনটিতেই তাঁর আক্রমণাত্মক মনোভাব ছিল না।
শিক্ষা বিভাগ
পাপ পংকিলতা থেকে মানবতাকে উদ্ধার করে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই রাসূল (স.) মদীনায় আগমন করেন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, পুরুষ-মহিলা যুবক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করে তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন মানব সভ্যতার ইতিহাসে। তাঁর প্রতি যে সর্বপ্রথম ওহী অবতীর্ণ হয় তাতে বলা হয়েছেঃ 'পড়, তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, যিনি মানুষকে জমাট রক্তবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছেন, পড়, তোমার প্রভূ অতি সম্মানিত, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন এবং মানুষ যা জানত না তাই শিক্ষা দিয়েছেন।" (সূরা আল-আলাক)।
মসজিদভিত্তিক শিক্ষাকেন্দ্র
মহানবী (স.) মসজিদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করেন। মদীনার মসজিদে নববীর এক কোণে একদল সাহাবী সার্বক্ষণিকভাবে রাসূল (স.)-এর নিকট থেকে নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন ও প্রশিক্ষণ লাভ করার জন্য অপেক্ষা করতেন। ইসলামের ইতিহাসে জ্ঞানপিপাসু এই দলটিকে আহলে সুফফা বলা হতো।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা
রাসূল (স)-এর মহান আদর্শ ছিলো সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা। রাষ্ট্র প্রশাসন ব্যবস্থায় কোন জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য এবং ব্যাপক পরিসরভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে তিনি সাহাবা কিরামের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। সকলের সম্মতিক্রমে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদক্ষেপসমূহ অনুমোদন করতেন। বদর যুদ্ধের কয়েদীদের মুক্তিদানের ক্ষেত্রে তিনি প্রবীণ সাহাবীদের পরামর্শ গ্রহণ করার মাধ্যমে জনগণের মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা জগৎ ধ্বংস না হওয়া অবধি চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url