ইসলামী রাষ্ট্রের কর ব্যবস্থা
কর ব্যবস্থা বলতে কী বুঝায় তা বলতে পারবেন, ইসলামের কর ব্যবস্থা কতটা জনহিতকর তা বর্ণনা করতে পারবেন, কি ধরনের কর ইসলামী রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্য তা বলতে পারবেন।
কর ব্যবস্থা
প্রতিটি রাষ্ট্রের উপর মৌলিক কতগুলো দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। এ সকল দায়িত্ব পালনের জন্য অর্থের প্রয়োজন। যেহেতু রাষ্ট্র ও সরকার জনগণের কল্যাণে নিয়োজিত তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনের ব্যয়ভারও জনগণকেই বহন করতে হয়। জনগণ থেকেই উক্ত অর্থ আদায় করা হয়। রাষ্ট্রের কার্য সম্পাদন এবং নাগরিকদের কল্যাণের জন্য নাগরিকদের নিকট হতে বাধ্যতামূলকভাবে যে. অর্থ আদায় করা হয় তাকে কর বলে।
এ কর ব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্রে যেমন বিদ্যমান রয়েছে ইসলামের স্বর্ণযুগেও তা ইসলামী রাষ্ট্রে কার্যকর ছিল এবং ভবীয্যতেও যেখানেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে এ ব্যবস্থা কাযকর থাকবে।
কারণ কর জনগণের উপর কোন বোঝা নয়। বরং তাদের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন এবং সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সরকারের ফান্ডে অর্থ জমা দেয়ার নামই হচ্ছে কর। কোন মানুষ নিজের বাহ্যিক কোন প্রয়োজনে অর্থ খরচ করা যেমন বোঝা মনে করে না অনুরূপভাবে পরোক্ষভাবে করও তার নিজের প্রয়োজনেই ব্যয় করা হয়ে থাকে, তাই করকেও বোঝা মনে করা উচিৎ নয়।
কর ব্যবস্থার ইসলামী আইনগত ভিত্তি
অনেক প্রকার কর রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভূমি কর। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন,
"হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর।" (সূরা আল-বাকারা :২৬৭)
আল্লাহ তা'আলা আরো বলেন-
"এর ফল আহার করবে আর ফল তোলবার দিনে এর হক প্রদান করবে এবং অপচয় করবেনা; নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।" (সূরা আল-আন'আম : ১৪১)
রাসূল (স.) বলেন-
যে জমি বৃষ্টি, ঝর্ণাধারা বা নদীর পানিতে সিক্ত হয় কিংবা যা নিজে নিজেই সিক্ত থাকে সে জমির উৎপাদিত ফসলের এক দশমাংশ এবং যে জমি বিভিন্ন উপায়ে পানি সেচের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে সিক্ত করা হয়, তার ফসলের বিশভাগের একভাগ ভূমি কর হিসেবে দিতে হবে। (আবু দাউদ)
জিযিয়া করের বেলায় আল্লাহ তা'আলা বলেন-
"যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে স্বহস্তে জিযিয়া দেয়।" (সূরা আত-তাওবা: ২৯)
হযরত উমর (রা) তার শাসনামলে আমদানী কর ধার্য করেছিলেন এবং সেক্ষেত্রে নূন্যতম একটা সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।
উল্লেখিত প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় যে, ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যয়ভার নির্ধারণ করার জন্য কর নির্ধারণের ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলা নিজে যেমন নির্দেশ করেছেন তেমনিভাবে আল্লাহর রাসূল (স.) এবং খোলাফায়ে রাশেদুন তা বাস্তবায়ন করেছেন।
আরো পড়ুন: হযরত উমরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা
করনীতি
ইসলামী রাষ্ট্র কর নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বর্তমানে প্রচলিত জনকল্যাণকর নীতিসমূহ অবলম্বন করতে পারবে। তবে যে বিষয়গুলো মৌলিকভাবে খেয়াল রাখতে হবে তা হচ্ছে, করের পরিমাণ এমন হতে পারবে না যার ফলে সমাজের কোন এক শ্রেণীর মানুষের ওপর তা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। করের আয় শুধু দেশ ও রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য বায়তুলমালেই জমা হবে, কোন ক্রমেই করের অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা যেন বিলাস বহুল জীবন যাপনে ব্যয় না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর এ বাণীকে স্মরণ করা উচিৎ-
করের শ্রেণীবিভাগ
কর নির্ধারণের প্রকৃতি ও ধরনের দিক বিচার করলে সাধারণতঃ কর দুই ভাগে বিভক্ত। যথা-
১. প্রত্যক্ষ কর
২ পরোক্ষ কর
প্রত্যক্ষ করের পরিচয়
যে রাজস্ব নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি কিংবা অবস্থার লোকদের উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান অনুযায়ী ধার্য করা হয়, তাকে 'প্রত্যক্ষ কর' বলে। যেমন- ফসলের উপর এক দশমাংশ বা এক বিশমাংশ ধার্যকৃত কর। এ কর দ্বারা করদাতা নিজেই প্রভাবিত হয়। এর প্রভাব অন্যদের উপর পড়ে না।
পরোক্ষ করের পরিচয়
যে কর সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যক্তি বিশেষের উপর ধার্য করা হয় কিন্তু মূলতঃ এর সবটি কিংবা অংশ বিশেষ পরিমাণ পরোক্ষভাবে জনসাধারণকে আদায় করতে হয় অর্থাৎ কর ধার্য করার ফলে করদাতার চেয়ে জনসাধরণ বেশি প্রভাবিত হয়। তাকে বলা হয় পরোক্ষ কর। যেমন- আয় কর, বর্তমানে আরোপিত ভ্যাট ইত্যাদি। এজাতীয় কর ধার্য করা হয় আয়কারীর উপর কিন্তু পরোক্ষভাবে করদাতা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করার মাধ্যমে জনসাধারণ থেকে তা আদায় করে নেয়।
কর আদায়ের খাতসমূহ
ইসলামী রাষ্ট্রের ব্যয়ভার বহন করার জন্য যে সকল খাত থেকে কর আদায় করা যাবে তা হচ্ছে-
১. ভূমি কর
২. জিযিয়া কর
৩. আমদানী-রপ্তানী কর
৪ আয় কর
৫ জরুরী প্রয়োজনে কর
৬ সামরিক কর
৭. বনজ ও সমুদ্র সম্পদের কর।
ভূমি কর
ভূমি কর সম্পর্কে ৩য় পাঠে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এ করের মধ্যে প্রথমত ওশর (একদশমাংশ) নিসফুল ওশর (এক বিশমাংশ) ও খারাজ উল্লেখযোগ্য।
জিযিয়া কর
জিযিয়া কর সম্পর্কেও ১ম পাঠে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে একটু বিস্তারিতভাবে জিযিয়া কর সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত অমুসলিম অধিবাসীদের নিকট হতে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে একটি বিশেষ কর গ্রহণ করা হয়। ইসলামের অর্থনৈতিক পরিভাষায় যাকে 'জিযিয়া কর' বলে। 'জিজিযা' অর্থ 'বিনিময়'। রাষ্ট্র তার প্রজা-সাধারণের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে দায়িত্ব গ্রহণ করে, তাদেরকে যে নিরাপত্তা দান করে, রাষ্ট্র তারই বিনিময়ে প্রয়োজন পরিমাণে কর আদায় করার অধিকার লাভ করে থাকে। 'জিযিয়া' অনুরূপ একটি কর। তা সংখ্যালঘু অমুসলিম নাগরিকদের উপর ধার্য করা হয়। কুরআন মাজীদের নিম্নোদ্ভূত আয়াতে এ কথাই বলা হয়েছে:
"যে পর্যন্ত না তারা নত হয়ে স্বহস্তে জিযিয়া দেয়।" (সূরা আত-তাওবা: ২৯)
অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন অমুসলিম প্রজাদের প্রধানত দু'টি কর্তব্য রয়েছে। প্রথমত রাষ্ট্রের পূর্ণ আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করা দ্বিতীয়ত রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার আর্থিক প্রয়োজন পূরণের জন্য ধার্যকৃত কর প্রদান করা।
আরো পড়ুন: ইসলামি রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা
একটি সুবিচারমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
আধুনিক যুগে কোন কোন মহল ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের উপর জিযিয়া কর ধার্যকরণকে মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকের মধ্যে বৈষম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতি বলে বর্ণনা করতে চান। তারা বলতে চান যে, এটা একটি অবিচার পূর্ণ আচরণ।
কিন্তু সঠিক চিন্তা ও যুক্তির নিরিখে তাদের উক্ত বক্তব্য কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং নিম্নে বর্ণিত কয়েকটি কারণে প্রমাণিত হয় যে, জিযিয়া কর একটি সুবিচারমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ
রাষ্ট্র হল সুসংগঠিত একটি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান। সমগ্র দেশের রক্ষণাবেক্ষণ নীতিগতভাবে ইসলামী রাষ্ট্রীয় আদর্শে বিশ্বাসী (মুসলিম) নাগরিকদের উপর ন্যস্ত হয়, অবিশ্বাসী (অমুসলিম) লোকদের উপর নয়। রাষ্ট্রের উপর কোনরূপ বহিরাক্রমণ হলে তা প্রতিহত করার জন্য সর্বতোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার দায়িত্ব দেশের সমগ্র মুসলিম জনসাধারনের উপর বর্তায়, অমুসলিমদের উপর ততটা এ দায়িত্ব বর্তায় না।
এজন্য ইসলামী রাষ্ট্র তাদের নিকট হতে দেশরক্ষার খাতে একটি বিশেষ কর আদায় করার নীতি অবলম্বন করেছে। তাই এ ব্যবস্থাকে 'সুবিচারপূর্ণ কর নীতি' বলা যেতে পারে। কারণ, এর ফলে দেশরক্ষার ব্যাপারে মুসলিমগণ জনশক্তি (man power) সরবরাহ করবে, আর দেশের অমুসলিমগণ আর্থিক প্রয়োজন পূরণ করবে। ইসলামী রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এরূপ নীতি অবলম্বন করা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত। আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের প্রধান দায়িত্ব উক্ত আদর্শে বিশ্বাসীদের উপর ন্যস্তকরণ বিজ্ঞানসম্মত ও সুবিচারমূলক ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য।
বস্তুত সকল প্রকার সচ্ছল মুসলমানের উপরই যাকাত আদায় করা যখন ফরয তখন অমুসলিমদের উপর একমাত্র 'জিযিয়া' কর আদায়ের নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হয় নি, তা অতি সহজেই বোধগম্য।
যে সকল অমুসলিমের উপর জিযিয়া কর প্রযোজ্য
'জিযিয়া' কিংবা অনুরূপ কর কেবল সেসব লোকের নিকট হতে আদায় করা হবে, সাধারণত যাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতা আছে এবং সে সঙ্গে এ কর প্রদানের সামর্থ্যও রয়েছে। পক্ষান্তরে যাদের অনুরূপ ক্ষমতা নেই-যেমন স্ত্রীলোক, শিশু, অক্ষম, বৃদ্ধ, পাগল, অন্ধ ও পংগু লোক কিংবা যারা নীতিগতভাবে যুদ্ধ বিমুখ বা যুদ্ধবিরোধী যথা পাদ্রী, পুজারী, ঠাকুর, গৃহত্যাগী বৈষ্ণব, বৈরাগী প্রভৃতি। তাদের উপর এ ধরনের কোন করই ধার্য করা হবে না।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, অমুসলিমদের উপর আরোপিত জিযিয়া করকে শুধু জিযিয়াই বলতে হবে ইসলামী অর্থনীতিতে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। প্রয়োজনে এ করকে অন্য নামেও নামকরণ করা যেতে পারে। আর অমুসলিমরা যদি জিযিয়া কর প্রদান করাকে অবিচারপূর্ণ আচরণ মনে করে থাকে তাহলে তারা ইচ্ছে করলে জিযিয়া না দিয়ে মুসলমানদের মত যাকাতের পরিমাণ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে পারে।
মূলত ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অনুগত অমুসলিম নাগারিকের নিরাপত্তা বিধান ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই জিযিয়া কর ধার্য করা হয়েছে। তাই যদি ইসলামী রাষ্ট্র কোন অমুসলিম নাগরিকের রক্ষণবেক্ষণে সক্ষম না হন তবে তাদের নিকট হতে মোটেই জিযিয়া কর আদায় করা যাবে না এমনকি যদি জিযিয়া গ্রহণ করা হয়ে থাকে তাও ফেরৎ দিতে হবে।
জিযিয়া করের পরিমাণ
ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান তার পরামর্শ সভার সাথে পার্লামেন্টে আলোচনা সাপেক্ষে সময় কাল ও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জিযিয়া করের পরিমাণ নির্ধারণ করবেন। আল্লাহ ও তার রাসূলের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সুষ্ঠু কোন বক্তব্য নেই। তবে জিযিয়ার পরিমাণ নির্ধানের কাজ রাষ্ট্র-সরকার ও অমুসলিম সংখ্যালঘুদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন করাই সঠিক ইসলামী পন্থা। প্রত্যেক ধনশালী উপার্জনশীল ব্যক্তির আর্থিক সামর্থ্য ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন- এ উভয় দিকে লক্ষ্য রেখে তা করতে হবে এবং এ ব্যাপারে দাতা ও গ্রহীতা কারো প্রতি যাতে বিন্দুমাত্র অবিচার না হয় সেদিকে উভয়কেই তীক্ষ্ণ ও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
কি বস্তু জিযিয়া কর হিসেবে দেওয়া যায়
জিযিয়া সাধারণত টাকায় আদায় করা হবে। কিন্তু পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে বিশেষ কোন শিল্পপণ্যের আকারেও তা আদায় করা যেতে পারে। নবী করীম (স.) ও খোলাফায়ে রাশেদুন বিভিন্ন শিল্পোৎপাদনকারীদের নিকট হতে জিযিয়া বাবদ শিল্পপণ্যও গ্রহণ করেছেন। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন-
"জিযিয়ার পরিমাণ কি হবে এবং কিসের মাধ্যমে তা আদায় করা হবে, তা শরীআত নির্ধারণ করে দেয়নি।" জিযিয়া বছরে মাত্র একবারই আদায় করা হবে, তার অধিক নয়। এ ব্যাপারে নবী করীম (স.)-এর নিম্নলিখিত বাণীটি একটি চূড়ান্ত ঘোষণা।
“যে ব্যক্তি কোন চুক্তিবদ্ধ (অমুসলিম সংখ্যালঘুর) প্রতি জুলুম করবে কিংবা তাদের সামর্থ্যের অধিক কোন বোঝা তাদের উপর চাপিয়ে দিবে, (কিয়ামতের দিন) আমি তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব।"
আমদানী ও রপ্তানী কর
প্রতিটি রাষ্ট্রই নিজের দেশে উৎপাদিত শিল্পপণ্যের উন্নতি সাধন করতে তৎপর। আবার যে সকল পণ্য নিজের দেশে উৎপাদিত হয় সেগুলো বিদেশ থেকে আমদানী বন্ধ করার চেষ্টা করে। কারণ, আমদানী বন্ধ না করলে নিজের দেশের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বাজারে বিক্রির হার কমে যাবে। দেশীয় পণ্য উৎপাদনে বাধার সৃষ্টি হবে এবং এর অগ্রযাত্রা হ্রাস পাবে।
তাই সাধারণত বিদেশী পণ্যের আমদানী নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কর ধার্য করা হয়। ফলে দেশের বাজারে তা দেশীয় পণ্যের মত কম মূল্যে বিক্রি করা যায় না যার ফলে বিদেশী পণ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যায়। বিদেশী পণ্যের উপর অর্পিত এ করতে আমদানী কর বলে।
ইসলামী রাষ্ট্রও এ ধরনের কর আরোপ করতে পারে। হযরত উমর (রা) তাঁর শাসনামলে এ ধরনের কর ধার্য করেছিলেন।
এমনিভাবে দেশের যে সব পণ্য বিদেশে সহজে রপ্তানী হলে নিজের দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে সে সব পণ্যের রপ্তানী রোধ করতে যে কর নির্ধারণ করা হয় তাকে রপ্তানী কর বলে।
এ ছাড়া কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিক যদি ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাস করে ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে চায়, তবে তাকে এক ধরনের কর প্রদান করতে হয়। তাও আমদানী করের আওতায় পড়বে।
আরো পড়ুন: অমুসলিম নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য
আমদানী ও রপ্তানী করের পরিমাণ
এ ধরনের করের পরিমাণ ইসলামী অর্থনীতি প্রবর্তকের পক্ষ থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। ইসলামী রাষ্ট্রের পরিচালকদের উপরই বিষয়টি ন্যস্ত। অবস্থার প্রেক্ষাপটে আলোচনা সাপেক্ষে আমদানী-রপ্তানী কর ধার্য হবে। সব সময়ের জন্য করের পরিমাণ এক হওয়া শর্ত নয়। আবস্থার আলোকে তা পরিবর্তনশীল।
সরকার প্রয়োজন বোধ করলে দেশী পণ্যের বিক্রয়ের উপরও কর আরোপ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে অল্প পুঁজির ব্যবসায়ীরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরী।
মোটকথা, ইসলামী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে পণ্য সামগ্রীর প্রচলন, এক স্থান হতে অন্য স্থানে আমদানী-রপ্তানী করার উপর কোনরূপ কর ধার্য হবে না। এ নিয়মে কোনরূপ রদ-বদল করার সুযোগ নেই। রাষ্ট্রের রপ্তানীকৃত পণ্য সামগ্রীর উপর যদি বিদেশীরা কর ধার্য করে তখনই ইসলামী রাষ্ট্রও সকল প্রকার বিদেশী শিল্প-পণ্যের উপর অনুরূপ হারে শুল্ক ধার্য করে দিবে।
আয়কর
আধুনিক রাষ্ট্রে কোন ব্যক্তির মাসিক অথবা বাৎসরিক আয় সরকার কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণ হলে তাকে শতকরা হারে একটা নির্ধারিত কর প্রদান করতে হয়, যাকে আয় কর বা ইনকাম ট্যাক্স বলা হয়।
ইসলামী অর্থনীতিতে যাকাত অনেকটা আয়করের মত, তবে যাকাত ইবাদাত আর আয়কর ইবাদাত নয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূল (স) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আদর্শ রাষ্ট্রের কোন আয়কর ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবুও অবস্থার আলোকে প্রয়োজন হলে ইসলামী রাষ্ট্র এ ধরনের কর আরোপ করতে পারবে এতে শরীঅতের মূলনীতির পরিপন্থি কিছু নেই।
জরুরী প্রয়োজনে কর
ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমাল কোন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যদি সম্পূর্ণরূপে শূন্য হয়ে পড়ে। কিংবা ব্যয় অপেক্ষা আয়ের পরিমাণ কমে যায় অথবা জরুরী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। যেমন নতুন কোন জাতীয় কল্যাণমূলক পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্য-অধিক অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে অথবা বিভিন্ন প্রকার আয়ের পরেও রাজ্যের সকল নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূর্ণ করা সম্ভব না হয়। বা বন্যা, ক্ষরা দেখা দেয় অথবা দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ ও বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দেয়, তা হলে ইসলামী রাষ্ট্র দেশবাসীর উপর আরো অতিরিক্ত কর ধার্য করতে পারবে। প্রখ্যাত ইসলামী রাজনীতিবিদ ইমাম মাওয়ার্দী 'আল-আহকামুস সুলতানীয়া' গ্রন্থে বলেন, জরুরী অবস্থায় সকল প্রকার ব্যয় বহনের দায়িত্ব সমগ্র মুসলমানদের উপরই বর্তাবে। প্রয়োজনের সময় তাদের নিকট হতে প্রয়োজন পরিমাণ অর্থ আদায় করা যাবে।
তাবুক যুদ্ধের সময় নবী করীম (স.) যাকাত, ওশর ইত্যাদি আদায় করার পরও আকস্মিকভাবে আরো অধিক অর্থের প্রয়োজন বোধ করেন ফলে মুসলমানদের নিকট তিনি সে জন্য অর্থ সাহায্যের দাবি পেশ করেন। হযরত উমর ও উসমান (রাঃ) এ সময় তাদের যাবতীয় ধন-সম্পদের অর্ধেক দান করেছেন এবং হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) তাঁর সম্পূর্ণ বিত্ত-সম্পদ এনে নবী করীম (স.)-এর খিদমতে পেশ করেন।
জরুরী অবস্থায় যে কর ধার্য করা হয় তা দুই প্রকার
১ এমন কর, যা সাধারণভাবে সকল মানুষের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্য ধার্য করা হয়।
২. এমন কর, যা অত্যাচারী শাসক কেবল তার বিলাসিতা ব্যয়ের জন্য আদায় করে থাকে এবং প্রকৃত জনস্বার্থের সাথে যার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। আলোচ্য দুই প্রকার কর কখনো সাময়িকভাবে ধার্য করা হয়, আবার কখনো কখনো স্থায়ীভাবেও ধার্য হয়ে থাকে।
ইসলামী রাষ্ট্রে ২য় প্রকার করের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কিন্তু প্রথম প্রকারের কর ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পূর্ণ ন্যায়সংগত। এরূপ কর কোন ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক ন্যায়সঙ্গতভাবে ধার্য করা হলে তা প্রদান করা নাগরিকদের একান্ত কর্তব্য। কারণ, এটা ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশ এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রধানের ন্যায়সঙ্গত ও কল্যাণকর সকল আদেশ পালন করা সকল নাগরিকরেই কর্তব্য।
কিন্তু অন্যায়ভাবে জনস্বার্থ হানিকর কোন কাজের জন্য যদি অতিরিক্ত ট্যাক্স ধার্য করা হয় তবে তা প্রদান করা মুসলমানদের কর্তব্য নয়। কারণ এ ধরনের ট্যাক্স ধার্য করা সম্পর্কে নবী করীম (স.) বলেছেনঃ "অতঃপর জেনে রাখ, আল্লাহ তা'আলা শাসকদেরকে জাতি ও জনগণের সংরক্ষক ও রক্ষণাবেক্ষণকারী হওয়ার আদেশ করেছেন এবং তাদেরকে এ জন্য নিয়োগ করা হয় নি যে, তারা জাতি ও দেশবাসীকে নতুন নতুন কর ভারে জর্জরিত ও নিঃস্ব করে দেবে।"
মুসলমানগণ এ ধরনের কর কেবল প্রদান না করেই ক্ষান্ত হবে না বরং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাও তাদের জন্য আবশ্যক।
সামরিক কর
উপারে বর্ণিত বিভিন্ন প্রকারের কর দ্বারা রাষ্ট্রের সকল কর্মকান্ড পরিচালিত হবে। আর বায়তুলমালে অর্থ মওজুদ থাকা অবস্থায় জনগণের উপর অতিরিক্ত কর ধার্য করা এমনকি যুদ্ধের জন্য হলেও উচিৎ নয়।
এরপরও কখনও যদি দেশের স্বাধীনতা সার্বভোমত্ব হুমাকির সম্মুখীন হয়। যুদ্ধের প্রয়োজন হয় এবং বায়তুলমালের অর্থ শেষ হয়ে যায় তবে ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনগণের উপর সামরিক কর ধার্য করা যেতে পারে। আর জনগণ বৃহত্তর স্বার্থে এ ধরনের বিষয়ে আপত্তি করবে না-এটাই স্বাভাবিক।
বন-সম্পদ ও সমুদ্র-সম্পদের উপর কর
ইসলামী রাষ্ট্রের বন-সম্পদ রাষ্ট্রীয় একটি উল্লেখযোগ্য আয়ের মাধ্যম। এটা সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীন থাকবে এবং এর যাবতীয় আয় রাষ্ট্রীয় বায়তুলমালে জমা হবে।
এছাড়া সকল প্রকার সামুদ্রিক সম্পদ ইসলামী রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম প্রধান উপায়। সামুদ্রিক সম্পদ-বিশেষ করে মৎস্য ও মুক্তার উপর কর ধার্য হতে পারে। হযরত উমর (রা.) সামুদ্রিক সম্পদের উপর কর ধার্য করা এবং তা যথাযথভাবে সংগ্রহ করার জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী নিয়োগ করেছেন। কোন এক কর্মচারীর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'সমুদ্র হতে উৎপন্ন সকল দ্রব্য হতেই রাজস্ব বাবদ এক-পঞ্চমাংশ আদায় করতে হবে, কারণ এটাও আল্লাহ তা'আলারই একটি দান। নদী, ঝিল, বিল ইত্যাদি হতে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণে যে মৎস্য উৎপাদন হবে তার এক-পঞ্চমাংশ ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালের জমা হবে। হযরত আলী (রা.) এর সূত্রপাত করেছিলেন। হযরত উমর ইবনে আবদুল আযীয (র) এমত পোষণ করতেন।
কর ব্যবস্থা আধুনিক রাষ্ট্রে যেমন স্বীকৃত ইসলামী অর্থনীতিতেও এটা একটি বৈধ ব্যবস্থা। জনগণের উপর অর্থনৈতিক নির্যাতনের সম্ভাবনা না থাকলে এবং ইসলামী শরীআতের মূলনীতির বিপরীত না হলে ইসলামী রাষ্ট্র ও আধুনিক যুগের প্রবর্তিত অনেক প্রকার কর আরোপ করতে পারবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url