খোলাফায়ে রাশেদূনের রাজস্ব ব্যবস্থা
খোলাফায়ে রাশেদূন সরকারের রাজস্ব আদায়ের বিভিন্ন খাত সম্পর্কে লিখতে পারবেন। খারাজ বা ভূমি করের হার সম্পর্কে বলতে পারবেন। বাইতুলমাল সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন।
রাজস্ব আদায়ের খাত
এ সম্পর্কে ৪র্থ ইউনিটে বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। মহানবী (স)-এর আমলে রাজস্ব আদায়ের খাত ছিল ৫টি। খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে এর সংখ্যা খুব একটা বৃদ্ধি পায় নি। তবে রাজস্বের পরিমাণ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। রাজস্ব আদায়ের খাতও উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। খাতগুলো নিম্নরূপ:
১। গানীমত, ২। যাকাত, ৩। 'উশর, ৪। জিযিয়া, ৫। খারাজ, ৬। ফাই ও ৭। হিমা।
১ . গাণীমত: যুদ্ধের মাঠে শত্রুদের কাছ থেকে যে সব অস্থাবর সম্পদ মুসলিম সৈনিকদের হস্তগত হতো সেগুলোকে গাণীমত যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বলা হতো। শরীয়তের আইন অনুসারে উক্ত সম্পদের ৫ ভাগের ৪ ভাগ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হতো এবং অবশিষ্ট ৫ ভাগের ১ ভাগ বায়তুলমালে জমা দেয়া হতো এ ৫ ভাগের ১ ভাগকে খুমুস বলা হতো। বর্তমান যুগে যুদ্ধাদের মধ্যে যুদ্ধে লব্ধ সম্পদের পাঁচ ভাগের চার অংশ বণ্টিত হবে না, কারণ এখন সৈনিকদের বেতন ধার্য করা হয়। এ চার অংশের সবটুকুই বায়তুলমালে জমা হবে।
২. যাকাত: যাকাত একটি শরীয়ত অনুমোদিত একটি ব্যবস্থা। কাজেই এর নিয়ম কানুনে কোন যুগেই পরিবর্তন আসে নি। তবে খলীফা উমর (রা) অশ্বের ওপর যাকাত ধার্য করেন। মহানবীর আমলে আরবদেশে অশ্বের সংখ্যা খুব কম ছিল, সে কারণে তিনি অশ্বের উপর যাকাত ধার্য করেন নি। খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে যুদ্ধবিগ্রহের জন্য অশ্বের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপকভাব বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রতি বছর বহুসংখ্যক অশ্ব বিদেশ হতে আমদানী করা হতো। ব্যবসায়ীদের কাছে অশ্ব ব্যবসা অতীব লাভজনক ছিল। পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে খলীফা উমর (রা) অশ্বের উপর যাকাত ধার্য করেন।
৩. 'উশর: 'উশর হল ভূমি রাজস্ব এটিও শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত। এটা কেবল মুসলমানদের উপর ধার্যকৃত ভূমি কর। প্রাকৃতিক পানি দ্বারা ভূমি চাষাবাদ হলে ঐ সব ভূমিতে উৎপন্ন শষ্যের উশর তথা দশভাগের এক অংশ কর ধার্য করা হতো। আর যেসব ভূমি সেঁচের মাধ্যমে চাষাবাদ হতো উক্ত ভূমির উৎপন্ন ফসলে বিশ ভাগের এক ভাগ করা হিসেবে ধার্য ছিল। এ কর তখনই আদায় করা হতো যখন উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ ৫ ওয়াসাক বা ৬০ সা' পরিমাণ হতো যার পরিমাণ বর্তমান যুগে ২৬ মণ ১০ সের। খোলাফায়ে রাশেদুন এ কর ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনেননি।
আরো পড়ুন: মুসলিম নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য
৪ জিযিয়া: ইসলামি রাষ্ট্রে সংখ্যালগু অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদানের বিনিময় তাদের উপর রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে কর ধার্য করা হয় তাকে জিযিয়া বলে। মহানবী (স)-এর আমলে জিযিয়ার পরিমাণ ছিল জনপ্রতি ১ দিরহাম। খলীফা উমর (রা) অন্যান্য সংস্কারের ন্যায় জিযিয়ার পরিমাণেও সংস্কার সাধন করেন। সাসানী সাম্রাজ্যে প্রচলিত রীতির ন্যায় তিনি জিযিয়া প্রদানকারীদের তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেন এবং আর্থিক সংগতি অনুসারে জিযিয়ার পরিমাণ ধার্য করেন। তিনি বিত্তশালী ব্যক্তিদের জনপ্রতি প্রতি বছরে ৪ দীনার, মধ্যবিত্তদের জনপ্রতি ২ দীনার ও নিম্নবিত্তদের জনপ্রতি ১ দীনার হিসেবে জিযিয়া ধার্য করেন। গরীব, দরীদ্র ও বিত্তহীনদের উপর কোন জিযিয়া ধার্য করা হতো না। তবে এ নিয়মের কিছু কিছু তারতম্য হতো। আমর ইবনুল আস মিসরে জন প্রতি সাধারণভাবে ২ দীনার জিযিয়া ধার্য করেন।
মুসলমানরাই প্রথম জিযিয়া আদায়ের রীতি প্রচলন করে নি। পারস্যের সাসানী সাম্রাজ্যে এবং রোমান সাম্রাজ্যেও এ কর প্রচলিত ছিল। মুসলমানদের সাথে তাদের পার্থক্য ছিল এই যে, রোমান বা সাসানীদের তুলনায় মুসলমানদের দ্বারা ধার্যকৃত জিযিয়ার পরিমাণ ছিল অনেকাংশে লঘু ও মানবিক এবং জিযিয়া কর দাতাদের প্রতি প্রদত্ত শর্ত মুসলমানেরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। কোন বিজিত অঞ্চলের জনসাধারণকে শত্রুর হাত হতে রক্ষা করতে পারবে না এরূপ আশংকা দেখা দিলে মুসলমান শাসকেরা উক্ত অঞ্চলের নাগরিকদের উপর হয় জিযিয়া ধার্যই করত না বা আদায়কৃত জিযিয়ার অর্থ প্রজা সাধারণকে ফেরৎ দিত। ইয়ারমুকের যুদ্ধের পূর্বে রোমানদের প্রস্তুতি দেখে আবু উবায়দা হিমস হতে সৈন্যদের নিয়ে পশ্চাদ পসারণ করেন এবং নগর ত্যাগের পূর্বে হিমস হতে আদায়কৃত জিযিয়ার সমুদয় অর্থ নগরবাসিদের ফেরৎ দেন। খলীফা উসমানের আমলে সাইপ্রাস বিজিত হয়েছিল। কিন্তু সাইপ্রাসবাসির উপর কোন জিযিয়া ধার্য করা হয় নি। কেননা সাইপ্রাস বাসিকে শত্রুর আক্রমণ হতে রক্ষা করা সম্ভব হবে কিনা সে বিষয়ে আরবদের মনে সন্দেহ ছিল। খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে কেবল অমুসলমান প্রজাকেই জিযিয়া দিতে হতো এবং কোন অমুসলিম প্রজা মুসলমানদের সাথে সামরিক অভিযানে অংশ গ্রহণ করলে বা কোন প্রকারে মুসলিম বাহিনীকে সাহায্যদান করলে সে বছরের জন্য তার জিযিয়া মওকুফ হয়ে যেত।
৫ খারাজ: অমুসলিমদের সম্পত্তিকে খারাজি সম্পত্তি বলে। খারাজ ছিল ভূমি রাজস্ব। অমুসলিমদের রাজ্য বিজয়ের পর যে ভূমি মুসলিমদের হস্ গত হতো তাকে খারাজী ভূমি বলে। মহানবীর (স) আমলে খারাজী ভূমির পরিমাণ ছিল অত্যন্ত নগণ্য। কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদূনের আমলে পারস্য এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিশাল এলাকা বিজিত হওয়ায় খারাজী ভূমির পরিমাণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং রাজস্বের অন্যতম প্রধান উৎসে পরিণত হয়।
এ সব সম্পত্তির আয় জনহিতোকর কার্যের জন্য পৃথক করে রাখা হতো। ইসলামের স্বার্থে উল্লেখযোগ্য সেবার জন্য ব্যক্তি বিশেষকে এ ভূমি হতে কিছু কিছু ইনাম বা পুরস্কার স্বরূপ প্রদান করা হতো। কিন্তু কোন ক্রমেই উক্ত সম্পত্তির খারাজ রহিতো হতো না।
খারাজের হার: খারাজী ভূমির খারাজ (কর) ফসলের ধরণ ও প্রকার হিসেবে নির্ধারিত হতো। যেমন:
ক. যব আবাদ উপযোগী ভূমির খারাজ।
খ. গম বা আখ আবাদ উপযোগী ভূমির খারাজ।
গ. শাকসব্জী আবাদযোগ্য ভূমির খারাজ।
ঘ. তুলা আবাদযোগ্য ভূমির খারাজ।
ঙ. খেজুর ও আঙ্গুর আবাদযোগ্য ভূমির খারাজ।
৬. ফাই: শত্রুদের বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করার পর যে সব স্থাবর সম্পত্তি বা ভূমি মুসলিমদের মালিকানায় এসে যেত তাহল ফাই ভূমি। ফাই শ্রেণীর ভূমিগুলো সরাসরি রাষ্ট্রের দখলে আসত। ভূমির প্রকৃত মালিক বর্গাদারকে চাষাবাদের অধিকার প্রদান করে ভূমি হতে যেরূপ আয় পেয়ে থাকে, মুসলিম রাষ্ট্র ফাই ভূমি হতেও অনুরূপ আয় পেত। খারাজী ভূমি হতে এর প্রভেদ এই যে, এটা হতে রাষ্ট্র নির্দিষ্ট খারাজ পেয়ে থাকে। কিন্তু ফাই ভূমি হতে রাষ্ট্র ভূমির মালিক হিসেবে উৎপাদিত ফসলের অংশ পেত। হযরত উমর (রা) এর সম্পত্তির আয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও জন কল্যাণের জন্য বায়তুলমালে জমা রাখতেন।
৭. হিমা বা পশুচারণ ভূমি: খলীফা উমর পশু চারণ ক্ষেত্র হিসেবে বিশাল বিশাল এলাকা খাস করে রাখেন। এসব ভূমিতে যাদের পশু চরত তারা রাষ্ট্রকে পশু কর দিত। তাঁর আমলে উক্ত পশুচারণ ক্ষেত্র থেকে পাওয়া পশুর পরিমাণ ছিল ৪.০০.০০০। এ পশুগুলো কর হিসেবে আদায় করা হয়।
আরো পড়ুন: হযরত উমরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা
বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা
বায়তুলমাল বা সরকারী কোষাগারে সাধারণভাবে রাষ্ট্রের সকল আয় জমা হতো। কিন্তু জমা দেয়ার সময় তা ৪টি প্রধান খাতে বিভক্ত করে জমা দেয়া হতো।
১. প্রথম খাতে জমা হতো গাণীমত এবং সদকার মাল।
২. দ্বিতীয় খাতে জমা পড়ত যাকাত ও 'উশূর।
৩. তৃতীয় খাতে জমা পড়ত অমুসলিমদের নিকট হতে আদায়কৃত 'খারাজ', 'জিজিয়া', 'ফাই'-এর মাল।
৪. চতুর্থ খাতে জমা হতো বিবিধ আয়ের অর্থ।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) এবং আবু বকর (রা)-এর আমলে বায়তুলমাল বা সরকারী কোষাগার ছিল না। অর্থ রাজধানীতে পৌঁছা মাত্র তা বন্টন করে দেয়া হতো। কিন্তু ওয়ালীদ ইবন হিশামের পরামর্শ ক্রমে খলীফা উমর (রা) মদীনায় সর্বপ্রথম কোষাগার বা বায়তুলমাল স্থাপন করেন এবং আবদুল্লাহ ইবন আরকামকে এর কোষাধ্যক্ষ
নিযুক্ত করেন। রাজধানী মদীনা এবং অন্যান্য প্রাদেশিক রাজধানীতে কোষাগারের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয় ও এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রহরী নিযুক্ত করা হয়। কোষাধ্যক্ষগণ ওয়ালী বা গভর্নর থেকে স্বাধীন ছিলেন। কুফার গভর্নর সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাসের সাথে আর্থিক ব্যাপারে কুফার কোষাধ্যক্ষ ইবনে মাসুদের মতানৈক্য হওয়ায় খলীফা উসমান সা'দকে পদচ্যুত করেন।
উমরের দীওয়ানঃ খলীফা উমর (রা)-এর আমলে অনেক সম্পদ মদীনার কোষাগারে এসে জমা হয়। সে সব সম্পদের সুষ্ঠু আয় ও ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণের জন্য খলীফা উমর প্রথম দীওয়ান (Secretariat) নামক একটি স্থায়ী বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য দীওয়ানকে দু'টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রথম ভাগে আয়ের ও দ্বিতীয় ভাগে ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষিত হতো। আয়ের প্রধান প্রধান উৎসগুলো ছিল 'আল-খুমস, 'আল-জিযিয়া', 'খারাজ', 'উশর', 'অর্ধউশূর', 'ফাই', 'যাকাত' ও 'সাদকা' এবং হিমা'। ব্যয়ের খাতগুলো ছিল যথাক্রমে-
১. গরীব, দুঃখীর সাহায্য, আদায়কারীর ভাতা, দাসমুক্তি, অক্ষম ব্যক্তির ঋণ পরিশোধ আল্লাহর পথের মুজাহিদ এবং পথিকদের সাহায্য দান।
২. বেসামরিক খাতের ব্যয়ভার নির্বাহ।
৩. সামরিক বিভাগের ব্যয়ভার নির্বাহ।
৪. জনহিতোকর কার্য সম্পাদন।
৫. অনাথ ও বেওয়ারিশ শিশুর লালন-পালন।
৬. সাধারণ ভাতা দান।
দীওয়ানে রক্ষিত তালিকা অনুসারে বেসামরিক ও সামরিক ব্যয় মিটানোর পর অবশিষ্ট অর্থ ধেকে সকল মুসলমানকে নিয়মিত ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা চালু করেন। তিনি সকল মুসলমানের তালিকা প্রস্তুত করে ভাতা দানের প্রথা প্রবর্তন করেন। মহানবীর স. আত্মীয়বর্গ ও ইসলামের ত্যাগ এবং ইসলাম গ্রহণের সময়কালের ভিত্তিতে তিনি ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে শ্রেণীভিত্তিক তালিকা প্রস্তুত করেন। সে তালিকাতে দাসগণও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ব্যয়ের খাতে বেসামরিক বিভাগকে প্রথম ও সামরিক বিভাগকে দ্বিতীয় গুরুত্ব দেয়া হয়।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url