মজলিসে শূরার সদস্যদের গুণাবলী, দায়িত্ব ও কর্তব্যে

মজলিসে শূরার ভূমিকা বর্ণনা করতে পারবেন।মজলিসে শূরার সদস্যদের গুণাবলী বর্ণনা করতে পারবেন। মজলিসে শূরার সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আলোচনা করতে পারবেন।

ভূমিকা 

ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় মজলিসে শূরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক উপায়ে গঠিত ও পরিচালিত হয়। মজলিসে শূরা ইসলামি রাষ্ট্র ও ইসলামি গণতন্ত্রের অপরিহার্য একটি মৌলিক উপাদান। মজলিসে শূরা ছাড়া ইসলামি রাষ্ট্র বা গণতন্ত্র কল্পনাই করা যায় না। কাজেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে মজলিসে শূরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

মজলিসে শূরা এমন এক সংস্থার নাম, যে সংস্থার সদস্যগণ রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় কর্মকান্ডে পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদান করেন। ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় একে একটি একাত্ম পার্লামেন্ট (Unitary Parliament) বলা হয়। ইসলামি বিধানে পারদর্শী ও রাজনৈতিক অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন নির্বাচিত ও সুসংঘবদ্ধ একাত্মক ব্যবস্থা বলে এর সদস্যগণের প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র অস্তিত্বের অধিকারী এবং ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন ও সত্য প্রকাশের অধিকারী। এ ধরনের মজলিসে শূরায় কোন দলাদলি নেই। মেজরিটি আর মাইনরিটি তথা সরকারি দল ও বিরোধী দল কিংবা মজুর-কৃষক ও ধনী-গরিবের কোন স্থায়ী দলবাজের অবকাশ এতে নেই। মজলিসে শূরার সদস্যগণ ইসলামের সুনির্দিষ্ট বিধান সম্মুখে রেখে সকল ব্যাপারে নিজ নিজ স্বাধীন মতামত প্রকাশ করেন। সত্য মতের সমর্থন এবং ভুল ও অন্যায় মতের প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করাই হবে প্রত্যেক সদস্যের জাতীয় ও ধর্মীয় কর্তব্য।

আরো পড়ুন: ইসলামি সরকার ও আধুনিক সরকার পদ্ধতির তুলনা

শূরা সদস্যদের যোগ্যতা ও গুণাবলী

কুরআনের আলোকে মজলিসে শূরার সদস্যদের অবশ্যই ইসলামি জীবন বিধান ও আইন-কানুন সম্পর্কে পূর্ণ অবহিত হতে হবে। জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত, আন্তরিক, নিষ্ঠাবান ও কল্যাণকামী হতে হবে। আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন হতে হবে। আমানতদার ও দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। অন্যথায় তাদের দ্বারা জাতীয় আদর্শ ব্যাহত হবে। ক্ষুন্ন হবে সার্বিক কল্যাণ, সারা দেশে ব্যাপক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে এবং জাতি ও রাষ্ট্র ধ্বংসে পতিত হবে।

কুরআনের দৃষ্টিতে একজন শ্রমিক বা কর্মচারীকে ও কর্মক্ষম এবং বিশ্বস্ত হতে হয়। কুরআনে বলা হয়েছে:

"তোমার মজুর হিসেবে উত্তম হবে সেই ব্যক্তি, যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত।" (সূরা আল-কাসাস: ২৬)

মজলিসে শু'রার সদস্যকেও যোগ্যতা সম্পন্ন ও বিশ্বস্ত হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে আরও ব্যাপকভাবে কাম্য।

মজলিসে শূরার উপর অর্পিত দায়িত্ব হচ্ছে, কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ইসলামি আইন উদঘাটন করা এবং ধারা হিসেবে সজ্জিত করা। এজন্য শূরা সদস্যদের- অন্তত তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্যদের কুরআন-সুন্নাহ'য় পারদর্শী হওয়া আবশ্যক। এ পর্যায়ে আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে:

"তোমরা যদি না জান, তবে জ্ঞানীগণকে জিজ্ঞাসা কর।" (সূরা আন-নাহল: ৪৩)

মজলিসে শূরার কাজ হচ্ছে জাতীয়, সামষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় তথা মানব জীবনের সকল বিষয়ে কুরাআন-হাদীসের আলোকে ইসলামি আইন প্রণয়ণ করা আর শূরার সদস্যদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর মৌলিকভাবে গবেষণার যোগ্যতা সম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। অন্যথায় তাদের দ্বারা দায়িত্ব পালন কোনক্রমেই সম্ভব হবে না। আয়াতের' আহলুয-যিকর' অর্থ 'আহলুল ইলম'-কুরআন সুন্নাহর জ্ঞান-এর অধিকারী। রাসূল (স.)-এর মজলিসে শূরার সদস্যগণ ছিলেন সাহাবা কিরাম। তাঁরা সকলেই বর্ণিত যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন।

রাসূলে করীম (স.) কুরআন ও সুন্নাহ-এর শিক্ষাদানের মাধ্যামে এ কাজের যোগ্যতা সম্পন্ন বিপুল সংখ্যক লোক তৈরী করেছিলেন। রাসূলে করীম (স.)-এর সময়ে ইসলামি রাষ্ট্রের বিভিন্ন শাখা ও বিভাগে এ ধরনের লোক নিয়োজিত ছিলেন। ইসলামি রাষ্ট্রের মজলিসে শূরায়ও এ ধরনের যোগ্যতা সম্পন্ন যথেষ্ট সংখ্যক লোক অবশ্যই থাকতে হবে, যারা কুরআন-সুন্নাহ সামনে নিয়ে গভীর সূক্ষ্ণ গবেষণা চালিয়ে প্রয়োজনীয় আইন উদ্ভাবন করতে সক্ষম। অন্যথায় নিত্য পরিবর্তনশীল সংঘটিত ঘটনা ও বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে ইসলামসম্মত আইন ধারাবদ্ধ করা মজলিসে শূরার পক্ষে সম্ভব হবে না।

ইসলামি গণতন্ত্রে মজলিসে শূরার ভূমিকা

ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও এর প্রকৃতি পৃথক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বর্তমানে প্রচলিত গণতন্ত্রের সকল সীমাবদ্ধতা ও সংকীর্ণতা থেকে ইসলামি গণতন্ত্র সম্পূর্ণ মুক্ত। ইসলামি গণতন্ত্র এমন গণতন্ত্র যেখানে কোন রাজনৈতিক দল থাকতে পারে না। সেখানে কেউ পদপ্রার্থী হতে পারে না। ইসলামি গণতন্ত্রের মূল কথা হচ্ছে-"যোগ্যতম ব্যক্তিকে নেতৃত্বে বসাতে হবে।"

ইসলামি গণতন্ত্রের পরিভাষায় সংসদকে বলা হয় মজলিসে শূরা। মজলিসে শূরা দু'ভাগে বিভক্ত-

১. মজলিসে আম: এটা সাধারণ পরিষদ বা নিম্ন পরিষদ। এতে অধিকাংশ জনগণ অংশগ্রহণ করে থাকে।

২. মজলিসে খাসঃ এটা উচ্চ পরিষদ। এখানে রাষ্ট্রের বিশেষ বিশেষ জ্ঞানী ও বিজ্ঞজনরা থাকেন।

আরো পড়ুন: খোলাফায়ে রাশেদূনের রাজস্ব ব্যবস্থা

ইসলামি গণতন্ত্রে মজলিসে শূরার দায়িত্ব ও কর্তব্য

ইসলামি গণতন্ত্রে মজলিশে শূরার দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো নিম্নরূপ-

পরামর্শদান

কুরআন ও হাদীসের ঘোষণানুযায়ী সমগ্র জাতির ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পরামর্শদানই হল মজলিসে শূরার প্রধান কাজ।

রাষ্ট্র পরিচালনা

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, দায়িত্ব পালন এবং পরামর্শ প্রদান করাও মজলিসে শূরার কর্তব্য।

রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ

রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের সমস্ত দায়িত্ব মজলিসে শূরাকেই বহন করতে হয়।

আইন প্রণয়ন

ইসলামি গণতন্ত্রে মজলিসে শূরার উপর বড় দায়িত্ব হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ইসলামি আইন বের করা ও ধারা হিসেবে সজ্জিত করা। এ জন্য শূরার সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশ সদস্যকেই কুরআন, সুন্নাহয় জ্ঞানী ও পারদর্শী হতে হবে। এ পর্যায়ে আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছেঃ "তোমরা যদি না জান, তবে জ্ঞানীগণকে জিজ্ঞেস কর।" (সূরা নাহল-৪৩)

কাজেই ইসলামি আইনের উৎস কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াসের উপর শূরার সদস্যদের ইজতিহাদী (গবেষণার) যোগ্যতা থাকতে হবে।

মহানবী (সাঃ)-এ সম্পর্কে বলেন, "তোমরা কুরআন-সুন্নাহয় পারদর্শী মুমিন লোকদের একত্র কর।" অতঃপর তাদের নিয়ে শূরা গঠন কর। তবে তাদের কোন এক জনের মতের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত নেবে না।" (সুনানে আবু দাউদ)

এখানে উল্লেখ্য যে, আধুনিক গণতন্ত্রে সংসদের মত ইসলামি গণতন্ত্রে মজলিসে শূরার আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নেই। বরং কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের বর্ণিত আইনকে বের করা ও প্রয়োগ করাই মজলিসে শূরার কর্তব্য।

যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে সিদ্ধান্তগ্রহণ

ইসলামি গণতন্ত্রে শূরার পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রের ভূমি, রাজস্ব ব্যবস্থা, প্রাদেশিক গভর্নর নিয়োগ, বদলি, যুদ্ধাভিযান পরিচালনা, খলীফা ও সরকার, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ, কর-আরোপ, শাসনকার্য পরিচালনা ইত্যাকার যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ড মজলিস শূরার পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত মোতাবেক হতে হবে।

অনুমোদন

রাষ্ট্রপ্রধানের বিভিন্ন কার্য ও মতামত মজলিসে শূরার অনুমোদন নিয়ে সম্পাদন করতে হয়।

জাতীয় আদর্শ নির্ধারণ

ইসলামি গণতন্ত্রে সামষ্টিক ও জাতীয় আদর্শ নির্ধারণে ও কর্মসূচি গ্রহণে মজলিসে শূরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে শূরার অনুমোদন ছাড়া কিছু করা যায় না।

গঠনতন্ত্র ও আইনের ব্যাখ্যাদান

ইসলামি গণতন্ত্রে মজলিসে শূরার ভূমিকার মধ্যে রয়েছে ইসলামি রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রণীত আইনের ব্যাখ্যাদান করা ও প্রয়োজনীয় সংশোধন করা।

আর্থিক অডিটঃ বায়তুলমালসহ যাবতীয় আর্থিক আয়-ব্যয়ের হিসাব পরীক্ষা করাও শূরার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।

অধিবেশনসমূহের কার্যপ্রণালী প্রণয়নঃ মজলিসে শূরার অধিবেশনসমূহের কার্যাবলীর নিয়ম-প্রণালী প্রণয়ন করা ও তা বাস্তবায়নে সাহায্য করা ও শূরার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।

প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ

রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান অনুযায়ী জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করাও শূরার কর্তব্য।

সৎ কাজে সাহায্য করা

সকল সৎ কাজে রাষ্ট্রপ্রধানকে সাহায্য করা শূরার অপরিহার্য কর্তব্য। "খলীফাগণ আমাদের মতই। যতক্ষণ তিনি আল্লাহ ও রাসূলের পথ অনুসরণ করবেন, ততক্ষণ আমরাও তাঁর অনুসরণ করব, অন্যথায় নয়।"

অন্যায় কাজ প্রতিরোধ

ইসলামি গণতন্ত্রে মজলিসে শূরার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার মধ্যে রয়েছে অন্যায় ও পাপের কাজে খলীফাকে পরামর্শ প্রদান বা সাহায্য করা যাবে না। বরং তা প্রতিরোধ করতে হবে। শরীআতের সীমালঙ্ঘন হয় এমন কোন কাজে তাকে সাহায্য করা যাবে না।

সারকথা

ইসলামি গণতন্ত্রে মজলিসে শূরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। এর কোন সদস্যই বংশীয় আভিজাত্য বা আর্থিক প্রাচুর্য্যের কারণে নির্বাচিত হন না। এ শূরার প্রত্যেক সদস্যই স্বাধীন মতামত প্রকাশের দাবিদার। এ শূরায় কোন দলাদলি, গ্রুপিং, মেজরিটি ও মাইনরিটির দোহাই দিয়ে কোন আইন পাস হয় না। সদস্যগণ ইসলামের বিধান সামনে রেখে স্বাধীনভাবে মতামত পেশ করবে। সত্য হলে মানবে, অসত্য হলে প্রতিরোধ করবে। সরকার পরিচালনায় এ শূরার ভূমিকা খুবই ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url