মার্কিন কংগ্রেসে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি

মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন, আইন প্রণয়নের বিভিন্ন পর্যায় ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

ভূমিকা 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি যুক্তরাজ্যের তুলনায় ভিন্ন প্রকৃতির। যুক্তরাজ্যে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ না থাকায় মন্ত্রীগণ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বেশিরভাগ বিলই মন্ত্রীগণ উত্থাপন করে থাকেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগ থাকায় রাষ্ট্রপতি বা শাসন বিভাগ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। মন্ত্রীগণ কোন বিল কংগ্রেসে উত্থাপন করতে পারেন না। এ ব্যাপারে কংগ্রেস ও তার কমিটিগুলো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারী বিল (Government Bill) বলে কোন বিলের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না। এখানে সরকারের তৈরী কোন বিলকেও কংগ্রেসের কোন সদস্যের মাধ্যমে পেশ করতে হয়। একমাত্র অর্থ বিল ছাড়া অন্য যে কোন বিল কংগ্রেসের যে কোন কক্ষে উত্থাপন করা যায়। অর্থ বিল কেবল মাত্র প্রতিনিধি সভাতে উত্থাপন করতে হয়।


মার্কিন কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন পদ্ধতিকে নিম্নোক্ত ৫টি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়। যথা-


বিল উত্থাপন;


কমিটি পর্যায়;


প্রতিনিধি সভায় বিলের অনুমোদন;


সিনেটে বিলের অনুমোদন এবং


রাষ্ট্রপতির অনুমোদন।


বিল উত্থাপন:

একমাত্র অর্থবিল ছাড়া অন্যান্য বিল মার্কিন কংগ্রেসের যে কোন কক্ষে উত্থাপন করা যায়। অর্থ বিল কেবলমাত্র প্রতিনিধি সভায় উত্থাপন করতে হয়। সিনেট বা প্রতিনিধি সভার যে কোন সদস্য নিজ নিজ কক্ষে বিল উত্থাপন করতে পারেন। উত্থাপক নিজের স্বাক্ষরযুক্ত বিলের একটি কপি প্রতিনিধি সভার ক্ষেত্রে ক্লার্কের এবং সিনেটের ক্ষেত্রে সেক্রেটারীর টেবিলের উপর রক্ষিত বাক্সের (hopper) মধ্যে ফেলে দেন। এভাবে বিলটি বাক্সের ভিতর রেখে দিলেই বিলটি উত্থাপন করা হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এরপর ক্লার্ক বা সেক্রেটারী বিলটিতে ক্রমিক নং বসিয়ে বিলের মুদ্রিত কপি অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করে। এ পদ্ধতিকে বিলের প্রথম পাঠ (First Reading) বলা হয়।


কমিটি পর্যায়:

প্রথম পাঠের পর বিলের শিরোনাম অনুসারে বিলটিকে সংশ্লিষ্ট স্থায়ী কমিটিতে বিচার বিবেচনার জন্য পাঠান হয়। কোন বিল কোন কমিটির কাছে পাঠাতে হবে তা সংশ্লিষ্ট কক্ষের সভাপতি ঠিক করেন। কমিটির নিকট বিল পাঠান হলে প্রথমে সংশ্লিষ্ট কমিটি বিলের গুরুত্ব সম্পর্কে বিচার বিবেচনা করেন। কমিটি যে সকল বিলকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে সেগুলোকে ফাইল বন্দি করে ফেলে রাখে। এভাবে শতকরা ৫০-৭৫ ভাগ বিল সম্পর্কে কোন আলোচনাই হয় না। কমিটি যে বিলগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে সেগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বিচার বিশ্লেষণ করে এবং নানা সূত্র থেকে সংশ্লিষ্ট বিল সম্পর্কে তথ্য ও মতামত সংগ্রহ করে। সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মচারী, বিভিন্ন স্বার্থ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধি বা বাইরের কোন লোকও বিল সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করতে পারে। বিতর্কমূলক বিল সম্পর্কে সাধারণতঃ প্রকাশ্য শুনানীর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। যাই হোক বিলটিকে বিস্তারিতভাবে বিচার বিবেচনা করে কমিটি সংশ্লিষ্ট বিল সম্পর্কে নিম্নোক্ত যে কোন একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে।


• কোন রকম সংশোধন না করে বিলটিকে সেই কক্ষে ফেরত পাঠাতে পারে বা অনুমোদনের সুপারিশ করতে পারে;


প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর বিলটি গ্রহণ করার জন্য কক্ষের নিকট সুপারিশ করতে পারে।


কেবলমাত্র শিরোনামটি ছাড়া বাকী সব অংশের পরিবর্তন সাধন করে কার্যতঃ একটি নতুন বিল পাঠিয়ে কক্ষের কাছে তা পাশের জন্য সুপারিশ করতে পারে:


• কমিটি ইচ্ছা করলে কোন বিলকে গ্রহণ না করার জন্য কক্ষের নিকট সুপারিশ করতে পারে।


সাধারণতঃ কমিটির চেয়ারম্যান বা তাঁর মনোনীত কোন সদস্য সংশ্লিষ্ট বিল সম্পর্কে কক্ষের নিকট রিপোর্ট পেশ করে থাকেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিলের ক্ষেত্রে কমিটিকে বিস্তারিতভাবে রিপোর্ট পেশ করতে হয়।


প্রতিনিধি সভায় বিলের অনুমোদনঃ

কমিটির রিপোর্টসহ বিলটি প্রতিনিধি সভায় ফেরত আসার পর প্রতিনিধি সভার ক্লার্ক বিলের চরিত্র ও শ্রেণী অনুযায়ী বিলটি তালিকাভুক্ত করেন। এ তালিকাকে ক্যালেন্ডার (Calendar) বলা হয়। প্রতিনিধি সভায় ৩ ধরনের ক্যালেন্ডার রয়েছে। যথা (ক) ইউনিয়ন ক্যালেন্ডার (Union Calendar) (খ) হাউজ ক্যালেন্ডার (House Calendar) (গ) প্রাইভেট ক্যালেন্ডার (Private Calendar)। রাজস্ব ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিলকে ইউনিয়ন ক্যালেন্ডার, পাবলিক বিলকে হাউজ ক্যালেন্ডার এবং প্রাইভেট বিলকে প্রাইভেট ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাধারণত রাজস্ব সংক্রান্ত বিলগুলো আগে আলোচনা করা হয়। সংশ্লিষ্ট কক্ষটি সম্পর্কে কমিটির রিপোর্ট বিচার বিবেচনার জন্য একটি সমগ্র কক্ষ কমিটি গঠন করা হয়। এ সময় স্পীকারের পরিবর্তে স্পীকার কর্তৃক মনোনীত একজন চেয়ারম্যান সভায় সভাপতিত্ব করেন। ১০০ জন সদস্য উপস্থিত থাকলে কোরাম বা গণপূর্তি হয় এবং সভার কাজ চলতে। থাকে। বিলের এ পর্যায়ের আলোচনাকে বিলের দ্বিতীয় পাঠ (Second Reading) বলে। এ পর্যায়ে বিলটির সংশোধনী উত্থাপন করা যায়। সমগ্র কক্ষ কমিটিতে আলোচনা শেষে বিলটিকে পুনরায় প্রতিনিধি সভায় প্রেরণ করা হয়। প্রতিনিধি সভায় সমগ্র কক্ষ কমিটির সুপারিশগুলো বিচার বিবেচনা করা হয়। একে বিলের তৃতীয় পাঠ (Third Reading) বলে। এরপর বিলটি পাশের জন্য ভোটে দেওয়া হয়। ভোটের ফলাফল অনুসারে বিলটি গৃহীত বা প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিলটি গৃহীত হলে স্পীকারের স্বাক্ষরসহ বিলটিকে সিনেটে পাঠান হয়।


সিনেটে বিলের অনুমোদন:

প্রতিনিধি সভায় কোন বিল গৃহীত হবার পর তা বিচার বিবেচনার জন্য সিনেটে প্রেরণ করা হয়। তবে প্রতিনিধি সভার মত সিনেটেও বিলটিকে নির্দিষ্ট কতকগুলো স্তর অতিক্রম করতে হয়। এক্ষেত্রে বিলের আলোচনা করার সময় প্রতিনিধি সভার সদস্যদের অপেক্ষা সিনেট সদস্যরা অধিক সময় ধরে আলোচনা করতে পারে। প্রতিনিধি সভা কর্তৃক গৃহীত বিলে সিনেট সম্মতি প্রদান করলে প্রতিনিধি সভার স্পীকার ও সিনেটের সভাপতির স্বাক্ষরযুক্ত বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়। কিন্তু সিনেট যদি প্রতিনিধি সভার সিদ্ধান্ত অনুমোদন না করে অর্থাৎ উভয় পক্ষের মধ্যে যদি মতভেদের সৃষ্টি হয় সেক্ষেত্রে বিলটিকে কনফারেন্স কমিটিতে (Conference Committee)-পাঠান হয়। কনফারেন্স কমিটি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উভয় কক্ষের মধ্যে মতানৈক্যেও মাধ্যমে আপোষ মীমাংসার চেষ্টা করে। কিন্তু কনফারেন্স কমিটি আপোস মীমাংসা করতে ব্যর্থ হলে এ কমিটিতেই বিলটির অপমৃত্যু ঘটে।


রাষ্ট্রপতির অনুমোদনঃ

কংগ্রেসের উভয় কক্ষে বিলটি গৃহীত হবার পর তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য প্রেরণ করা হয়। রাষ্ট্রপতি বিলটি সম্পর্কে তিন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। প্রথমতঃ রাষ্ট্রপতি বিলে স্বাক্ষর দিলে বিলটি আইনে পরিণত হয়। দ্বিতীয়তঃ রাষ্ট্রপতি বিলে স্বাক্ষর দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলে বা ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করলে বিলটি যে কক্ষে উত্থাপিত হয়েছিল ১০ দিনের মধ্যে সেই কক্ষে ফেরত পাঠাতে হয়। এ অবস্থায় কংগ্রেসের উভয় কক্ষের প্রত্যেকটিতে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে বিলটি পুনরায় গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়াই বিলটি আইনে পরিণত হয়। তৃতীয়তঃ আবার কংগ্রেসের অধিবেশন চলাকালে রাষ্ট্রপতি যদি ১০ দিনের মধ্যে কোন বিলে সম্মতি প্রদান না করে সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়াই বিলটি আইনে পরিণত হয়ে যায়। তবে ঐ দশ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই যদি কংগ্রেসের অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে সেক্ষেত্রে বিলটি বাতিল হয়ে যায়। মার্কিন রাষ্ট্রপতির এ ক্ষমতাকে পকেট ভেটো (Pocket Veto) বলে। এভাবে ভেটো প্রয়োগ করে বা ভেটো প্রয়োগের ভীতি প্রদর্শন করে মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কার্যকে যথেষ্ট পরিমাণে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে ক্ষমতাসন্ত্রীকরণ নীতি বহাল থাকলেও এখানে ক্ষমতার 'ভারসাম্য নীতি'র প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়।


সারকথাঃ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে আইন প্রণয়ন পদ্ধতি যুক্তরাজ্যের তুলনায় ভিন্ন প্রকৃতির। যুক্তরাজ্যে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ না থাকায় মন্ত্রীগণ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট বেশিরভাগ বিলই মন্ত্রিগণ উত্থাপন করে থাকেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়োগ থাকায় রাষ্ট্রপতি বা শাসন বিভাগ আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। মন্ত্রীগণ কোন বিল কংগ্রেসে উত্থাপন করতে পারেন না। এ ব্যাপারে কংগ্রেস ও তার কমিটিগুলো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সরকারী বিল (Government Bill) বলে কোন বিলের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় না। এখানে সরকারের তৈরী কোন বিলকেও কংগ্রেসের কোন সদস্যের মাধ্যমে পেশ করতে হয়। একমাত্র অর্থ বিল ছাড়া অন্য যে কোন বিল কংগ্রেসের যে কোন কক্ষে উত্থাপন করা যায়। অর্থ বিল কেবল মাত্র প্রতিনিধি সভাতে উত্থাপন করতে হয়।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url