অমুসলিম নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য
অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে বলতে পারবেন। যে সব অধিকার শুধু অমুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তা লিখতে পারবেন। অমুসলিম নাগরিকের জান-মালের নিরাপত্তার উপর বিস্তারিত আলোচনা করতে পারবেন। উপসনালয় স্থাপনে অমুসলিমদের অধিকার কতটুকু এ সম্পর্কে বর্ণনা করতে পারবেন।
ভূমিকা
মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকের মধ্যে মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নেই। ইসলামি রাষ্ট্রে একজন মুসলিম নাগরিক যে সকল অধিকার ভোগ করে তার প্রায় সবকটি অধিকার একজন অমুসলিম নাগরিকও ভোগ। করতে পারবে। নিম্নে অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার সম্পর্কে বিশেষভাবে আলোচনা করা হল।
জীবনের নিরাপত্তার অধিকার
মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের জীবনের মূল্য আইনের চোখে সমান। কোনো মুসলি যদি অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে, তাহলে একজন মুসলিম নাগরিককে হত্যা করলে যেমন তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় ঠিক অনুরূপভাবে এ ক্ষেত্রেও হত্যাকারীকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। রাসূল (স) -এর আমলে জনৈক মুসলিম একজন অমুসলিমকে হত্যা করলে তিনি খুনীকে মৃত্যুদন্ড দেন। তিনি বলেন:
"যে নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে, তার রক্তের বদলা নেয়ার দায়িত্বও আমার।
হযরত উমর (রাঃ)-এর আমলে বকর ইবনে ওয়ায়েল গোত্রের এক ব্যক্তি জনৈক হিরাবাসী অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে। তিনি খুনীকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণের আদেশ দেন।
হযরত উসমান (রা)-এর আমলে হযরত উমরের ছেলে উবায়দুল্লাহকে হত্যার পক্ষে রায় দেয়া হয়। কেননা ভিনি হযরত উমর (রা)-এর হত্যার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে হরমুযান ও আবু লুলুর মেয়েকে হত্যা করেন।
হযরত আলী (রা)-এর আমলে জনৈক মুসলিম জনৈক অমুসলিমের হত্যার দায়ে গ্রেফতার হয়। যথারীতি দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তিনি তাকে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। এই সময় নিহত বাক্তির ভাই এসে বললো, আমি মাফ করে দিয়েছি।" কিন্তু তিনি তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে বললেন: ওরা বোধ হয় তোমাকে ভয় দেখিয়েছে। সে বললো। না, আমি রক্তপণ পেয়েছি এবং আমি বুঝতে পেরেছি যে, ওকে হত্যা করলে আমার ভাই ফিরে আসবে না। তখন তিনি খুনীকে ছেড়ে দিলেন এবং বললেন:
আমাদের অধীনস্থ অমুসলিম নাগরিকদের রক্ত আমাদের রক্তের মতোই এবং তাদের রক্তপণ আমাদের রক্তপণের মতোই।
অপর এক বর্ণনা মুতাবিক হযরত আলী (রা) বলেছিলেন:
"তারা আমাদের নাগরিক হতে রাযী হয়েছে এই শর্তে যে, তাদের সম্পত্তি আমাদের সম্পত্তির মতো এবং তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতো মর্যাদাসম্পন্ন হবে।"
এ কারণেই ফিকহবিদগণ এই বিধান প্রণয়ন করেছেন যে, কোনো অমুসলিম নাগরিক কোনো মুসলিম-এর হাতে ভুলক্রমে নিহত হলে তাকেও অবিকল সেই রক্তপণ দিতে হবে, যা কোনো মুসলিম নাগরিকের নিহত হবার ক্ষেত্রে। দিতে হয়।
ফৌজদারী দন্ডবিধির ক্ষেত্রে অধিকার
ফৌজদারী দন্ডবিধি মুসলিম অমুসলিম সকলের জন্য সমান। অপরাধের যে সাজা মুসলিম নাগরিককে দেয়া হয়, অমুসলিম নাগরিককেও তাই দেয়া হবে। অমুসলিম নাগরিকের কোন সম্পদ যদি মুসলিম চুরি করে কিংবা মুসলিম নাগরিকের কোন সম্পদ যদি অমুসলিম চুরি করে, তাহলে উভয় ক্ষেত্রেই চোরের হাত কেটে ফেলা হবে। কারো ওপর ব্যভিচারের মিথ্যা অপবাদ আরোপ করলে অপবাদ আরোপকারী মুসলিম হোক অথবা অমুসিলম হোক উভয়কে একই শাস্তি দেয়া হবে। অনুরূপভাবে ব্যভিচারের শাস্তিও মুসলিম ও অমুসলিমের জন্য একই রকম। তবে মদের বেলায় অমুসলিমদেরকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কারণ মদ তাদের জন্য হালাল।
দেওয়ানী আইন প্রয়োগের সমান অধিকার সংরক্ষণ করার অধিকার
দেওয়ানী আইনের ক্ষেত্রে মুসলিম ও অমুসিলম নাগরিক সমান। "তাদের সম্পত্তি আমাদের সম্পত্তির মতো" হযরত আলী (রাঃ)-এর এ উক্তির তাৎপর্য এই যে, মুসলিমদের সম্পত্তি যেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় অমুসলিমদের সম্পত্তিও অনুরূপভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে এবং আমাদের ও তাদের দেওয়ানী অধিকার সমান ও অভিন্ন হবে। মুসলিমদের ওপর যে সব দায় দায়িত্ব অর্পিত হয় অমুসলিমের ওপরও তাই অর্পিত হবে।
ব্যবসায়ের যেসব পন্থা আমাদের জন্য নিষিদ্ধ, তা তাদের জন্যও নিষিদ্ধ তবে অমুসলিমরা শুধু শুকরের বেচাকেনা, খাওয়া এবং মদ প্রস্তুত করা পান ও কেনাবেচা করতে পারবে। আর তা মুসলিমদের জন্য বৈধ নয়। কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিমের মদ বা শুকরের ক্ষতি সাধন করলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। দূররে মুখতার গ্রন্থে আছেঃ "কোন মুসলিম যদি অমুসলিমদের মদ ও শুকরের ক্ষতি করে তবে সে তার মূল্য দিতে বাধ্য থাকবে।"
সম্মান পাওয়ার ক্ষেত্রে অধিকার
একজন অমুসলিমের জন্য কোনভাবে কোন মুসলিমকে অপমান ও লাঞ্ছিত করা যেমনি অবৈধ ঠিক অনুরূপভাবে একজন মুসলিমের জন্য একজন অমুসলিমকে অপমান করা অবৈধ।
মুখ বা হাত-পা দিয়ে কষ্ট দেয়া, গালি দেয়া, মারপিট করা বা কুৎসা রটনা করা যেমনিভাবে একজন অমুসলিদের
জন্য অবৈধ, অনুরূপভাবে এসব কাজ অমুসলিমের বেলায়ও অবৈধ। দূররে মুখতার গ্রন্থে আছে: "তাকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব এবং তার গীবত করা মুসলিমদের গীবত করার মতোই হারাম।"
চিরস্থায়ী নিরাপত্তা বিধান
অমুসলিমদের সাবি সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চুক্তি মুসলিমদের জন্য চিরস্থায়ীভাবে বাধ্যতামূলক। অমুসলিমগণ ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিক থাকার চুক্তি করার পর মুসলিমরা তা কখনও ভাংতে পারে না। অপরদিকে অমুসলিমদের এখতিয়ার আছে যে, তারা যতদিন খুশী তা বহাল রাখতে পারে এবং যখন ইচ্ছা ভেংগে দিতে পারে। 'বাদায়ে' নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে:
"অমুসলিমদের নিরাপত্তা দানের চুক্তি মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক। মুসলিমরা কোনো অবস্থাতেই তা ভাংতে পারে না। পক্ষান্তরে অমুসলিমদের পক্ষে তা বাধ্যতামূলক নয়। তারা যদি আমাদের নাগরিকত্ব ত্যাগ করতে চায় তবে তা করতে পারে।"
অমুসলিম নাগরিক যতো বড় অপরাধই করুক, তাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয় না। এমনকি জিযিয়া কর বন্ধ করে দিলে, কোনো মুসলিমকে ব্যক্তিগত কারণে হত্যা করলে রাষ্ট্র প্রধানের সঙ্গে খারাপ আচরণ করলে অথবা কোনো মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করলেও তার নাগরিকত্ব বাতিল হয় না এবং সে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে না। এসব কাজের জন্য তাকে অপরাধী হিসেবে শাস্তি দেয়া যাবে। কিন্তু বিদ্রোহী আখ্যায়িত করে নাগরিকত্বহীন করা যাবে না। তবে শুধু দুই অবস্থায় একজন অমুসলিম নাগরিকত্বহীন হয়ে যায়। একঃ যদি সে ইসলামি রাষ্ট্র ছেড়ে দিয়ে শত্রুদের সাথে মিলিত হয়। দুইঃ যদি সে ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে খোলাখুলি বিদ্রোহে লিপ্ত হয় এবং অরাজকতার সৃষ্টি করে।
পারিবারিক বিধানের ক্ষেত্রে অধিকার
অমুসলিমদের ঘরোয়া কর্মকান্ড তাদের নিজস্ব পারিবারিক আইন অনুসারে নির্ধারু করা হবে। তাদের উপর ইসলামি আইন কার্যকর করা যাবে না। আমাদের ঘরোয়া জীবনে যেসব কাজ অবৈধ, তা যদি তাদের ধর্মীয় ও জাতীয় আইনে বৈধ হয় তাহলে ইসলামি আদালত তাদের আইন অনুসারেই ফায়সালা দেবে। উদাহরণ স্বরূপ, সাক্ষী ছাড়া বিয়ে, মুহর ছাড়া বিয়ে, ইদ্দতের মধ্যে পুনরায় বিয়ে অথবা ইসলামে যাদের সাথে বিয়ে ইত্যাদি নিষিদ্ধ তাদের সাথে বিয়ে যদি তাদের আইনে বৈধ থেকে থাকে, তাহলে তাদের জন্য এসব কাজ বৈধ বলে মেনে নেয়া হবে। খোলাফায়ে রাশেদীন এবং তাদের পরবর্তী সকল যুগে ইসলামি সরকারগুলো এই নীতিই অনুসরণ করেছে। হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযীয এ ব্যাপারে হযরত হাসান বসরীর কাছে নিম্নরূপ প্রশ্ন করেছিলেন:
"খোলাফায়ে রাশেদীন অমুসলিম নাগরিকদেরকে নিষিদ্ধ মেয়েদের সাথে বিয়ে করা, মদ পান ও শুকরের মাংস খাওয়ার ব্যাপারে স্বাধীনতা দিলেন কিভাবে ?"
জবাবে হযরত হাসান লিখলেন
"তারা জিযিয়া দিতে এজন্যই সম্মত হয়েছে যে, তাদেরকে তাদের আকীদা বিশ্বাস অনুসারে জীবন যাপন করার স্বাধীনতা দেয়া হবে। আপনার কর্তব্য পূর্ববর্তীদের পদ্ধতি অনুসরণ করা, নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করা নয়।"
তবে কোনো ক্ষেত্রে যদি বিবদমান উভয় পক্ষ স্বয়ং ইসলামি আদালতে আবেদন জানায় যে ইসলামি শরীয়াত মুতাবিক তাদের বিবাদের ফায়সালা করা হোক, তবে আদালত তাদের ওপর শরীয়াতের বিধান কার্যকর করবে।
তাছাড়া পারিবারিক আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো বিবাদে যদি একপক্ষ মুসলিম হয়, তাহলে ইসলামি শরীয়াত মুতাবিক ফায়সালা হবে। উদাহরণ স্বরূপ-একজন খ্রিস্টান মহিলা কোনো মুসলিমের স্ত্রী থাকা অবস্থায় তার স্বামী মারা গেলো, এমতাবস্থায় এই মহিলাকে শরীয়াত মুতাবিক স্বামীর মৃত্যুজনিত ইদ্দত পুরোপুরি পালন করতে হবে। ইদ্দতের ভেতরে সে বিয়ে করলে সে বিয়ে বাতিল বলে গণ্য হবে।
ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে অধিকার
অমুসলিমদের ধর্মীয় ও জাতীয় অনুষ্ঠানাদি প্রকাশ্যভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে উদযাপন করা সম্পর্কে ইসলামের বিধান এই যে, অমুসলিমরা তাদের নিজস্ব জনপদে এটা অবাধে করতে পারবে। তবে একান্ত ইসলামি জনপদগুলোতে ইসলামি রাষ্ট্রের সরকার ইচ্ছা করলে তাদেরকে এ ব্যাপারে অবাধ স্বাধীনতাও দিতে পারবে। আবার কোনো ধরনের কড়াকড়ি আরোপ করতে চাইলে তাও করতে পারবে। "বাদায়ে" গ্রন্থে বলা হয়েছে। "যেসব জনপদ বিধিবদ্ধ ইসলামি জনপদ নয়, সেখানে অমুসলিমদেরকে মদ ও শুকর বিক্রি, ক্রুশ বহন করা ও শংখ ধ্বনি বাজানোতে বাধা দেয়া যাবে না। চাই সেখানে মুসলিম অধিবাসীদের সংখ্যা যতোই বেশী হোক না কেন। তবে বিধিবদ্ধ ইসলামি অঞ্চলে অর্থাৎ যেসব জনপদকে জুময়া, ঈদ ও ফৌজদারী দন্ডবিধি প্রচলনের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে, এমন অঞ্চলে এ সব কাজ পছন্দনীয় নয়। তবে যে সমস্ত পাপ কাজকে তারাও নিষিদ্ধ মনে করে সেসব কাজ প্রকাশ্যে করতে তাদেরকে সর্বাবস্থায়ই বাঁধা দেয়া হবে। চাই সেটা মুসলিমদের জনপদে হোক কিংবা তাদের জনপদে হোক।"
উপাসনালয়গুলোর অভ্যন্তরে তারা সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে। ইসলামি রাষ্ট্রের সরকার তাতে হস্তক্ষেপ করবে না।
উপাসনালয় স্থাপনের অধিকার
একান্ত মুসলিম জনপদগুলোতে অমুসলিমদের যেসব প্রাচীন উপাসনালয় থাকবে, তাতে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। উপাসনালয় যদি ভেংগে যায়, তবে তা একই জায়গায় পূর্ননির্মাণের অধিকারও তাদের আছে।
তবে যেগুলো একক মুসলিম জনপদ নয়, তাতে অমুসলিমদের নতুন উপাসনালয় নির্মাণের অবাধ অনুমতি রয়েছে। অনুরূপভাবে যেসব এলাকা এখন আর বিধিবদ্ধ ইসলামি জনপদ নেই, সরকার সেখানে জুমআ, ঈদ ও ফৌজদারী দন্ডবিধির প্রচলন বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানেও অমুসলিমদের নতুন উপাসনালয় নির্মাণ নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের অধিকার রয়েছে
জিযিয়া কর আদায়ে সুবিধা দানের ক্ষেত্রে অধিকার
জিযিয়া কর আদায়ে অমুসলিম নাগরিকদের ওপর কঠোরতা প্রয়োগ করা নিষিদ্ধ। তাদের সাথে নম্র ও কোমল ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। তাদের ক্ষমতার বাইরে কোন বোঝা তাদের উপর চাপাতে নিষেধ করা হয়েছে। হযরত উমরের নির্দেশ ছিলো, "যে পরিমাণ সম্পদ রাষ্ট্রকে প্রদান করা তাদের সামর্থ্যের বাইরে তা দিতে তাদেরকে বাধ্য করা চলবে না।"
জিযিয়ার বদলায় তাদের ধনম্পদ নীলামে দেয়া যাবে না। হযরত আলী (রা) তাঁর জনৈক কর্মচারীকে এ মর্মে নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন:
"কর খাজনা বাবদ তাদের গরু, গাধা, কাপড়-চোপড় বিক্রী করো না।"
অপর এক ঘটনায় হযরত আলী (রা) স্বীয় কর্মচারীকে পাঠানোর সময় বলে দেনঃ "তাদের শীত-গ্রীষ্মের কাপড়, খাবারের উপকরু ও কৃষি কাজের পশু খাজনা আদায়ের জন্য বিক্রি করবে না, তাদেরকে প্রহার করবে না, দাঁড় করে রেখে শাস্তি দেবে না এবং খাজনার বদলায় কোনো জিনিস নিলামে দিবে না। কেননা আমরা তাদের শাসক হয়েছি, এই জন্য কোমল ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে কর আদায় করাই আমাদের দায়িত্ব। তুমি আমার আদেশ অমান্য করলে আল্লাহ আমার পরিবর্তে তোমাকে পাকড়াও করবেন। আর আমি যদি জানতে পারি যে, তুমি আমার আদেশের বিপরীত কাজ করছো, তাহলে আমি তোমাকে পদচ্যুত করবো।
জিযিয়া আদায়ে যে কোন ধরনের কঠোরতা আরোপ করা নিষিদ্ধ। হযরত উমর (রা) তাঁর গভর্নর হযরত আবু উবায়দাকে যে ফরমান পাঠিয়েছিলেন তাতে অন্যান্য নির্দেশের সাথে এ নির্দেশও ছিলো:
"মুসলিমদেরকে অমুসলিমদের উপর যুলুম করা, কষ্ট দেয়া এবং অন্যায়ভাবে তাদের সম্পত্তি ভোগ দখল করা থেকে বিরত রেখো।"
সিরিয়া সফরকালে হযরত উমর (রা) দেখলেন, সরকারী কর্মচারীরা জিযিয়া আদায় করার জন্য অমুসলিম নাগরিকদের শাস্তি দিচ্ছে। তিনি তাদের বললেন, ওদের কষ্ট দিও না। তোমরা যদি ওদের কষ্ট দাও তবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তোমাদের কঠোর শাস্তি দেবেন।"
হিশাম ইবনে হাকাম দেখলেন, জনৈক সরকারী কর্মচারী জিযিয়া আদায় করার জন্য জনৈক কিবতীকে রোদে দাঁড় করিয়ে রাখছেন। তিনি তাকে তিরস্কার করলেন এবং বললেন যে, আমি রাসূল (স)-কে বলতে শুনেছি।
"যারা দুনিয়ায় মানুষকে শাস্তি দেয়, আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন।"
মুসলিম ফিকাহবিদগণ জিযিয়া প্রদানে অস্বীকারকারীদের বড় জোর বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়ার অনুমতি দিয়েছেন। ইমাম আবু ইউসুফ বলেন, "তবে তাদের সাথে সদয় আচরণ করা হবে এবং প্রাপ্য জিযিয়া না দেয়া পর্যন্ত আটক করে রাখা হবে।"
যেসব অমুসিলম নাগরিক দারিদ্র্যের শিকার ও পরমুখাপেক্ষী হয়ে যায়, তাদের জিযিয়া তো মাফ করা হবেই, উপরন্ত্র ইসলামি কোষাগার থেকে তাদের জন্য নিয়মিত সাহায্যও বরাদ্দ করতে হবে। হযরত খালিদ (রা) হীরা বাসীদের যে লিখিত নিরাপত্তা সনদ দিয়েছিলেন তাতে এ কথাও লেখা ছিলো যে-
"আমি হীরাবাসী অমুসলিমদের জন্য এ অধিকারও সংরক্ষণ করলাম যে, তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বাখকোর দরুদ কর্মক্ষমতা হারিয়ে বসেছে, যার ওপর কোনো দুর্যোগ নেমে এসেছে, অথবা যে পূর্বে ধনী ছিলো, পরে দরিদ্র হয়ে গেছে, ফলে তার স্বধর্মের লোকেরাই তাকে দান দক্ষিণা দিতে শুরু করেছে, তার জিযিয়া মাফ করে দেয়া হবে এবং তাকে ও তার পরিবার-পরিজন ও সন্তানদেরকে বায়তুলমাল থেকে ভক্ত পোষণ দেয়া হবে।"
একবার হযরত উমর (রা) জনৈক বৃদ্ধ লোককে ভিক্ষা করতে দেখে তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বললো, "কী আর করবো বাপু, জিযিয়া দেয়ার জন্য ভিক্ষে করছি।" এ কথা শুনে তিনি তৎক্ষণাত তার জিযিয়া মাফ ও তার। তরু পোষণের জন্য মাসিক বৃত্তি নির্ধারু করে দিলেন। তিনি কোষাগারের কর্মকর্তাকে লিখলেন, "আল্লাহর কসম, এটা কখনো ইনসাফ নয় যে, আমরা যৌবনে তার দ্বারা উপকৃত হবো, আর বার্ধক্যে তাকে অপমান করবো।"
দামেস্ক সফরের সময়ও হযরত উমর (রা) অক্ষম অমুসলিম নাগরিকদের জন্য বৃত্তি নির্ধারণ করার আদেশ জারী করেছিলেন।
ইমাম আবু ইউসুফ বলেন
"কোন অমুসলিম নাগরিক তার কাছে প্রাপ্য জিযিয়া পুরো অথবা আংশিক দেয়ার আগেই মারা গেলে তা ভার। উত্তরাধিকারীদের কাছ থেকে বা তার পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে আদায় করা হবে না।"
কর প্রদান করে ব্যবসা-বাণিজ্য করার অধিকার
মুসলিম ব্যবসায়ীদের মতো অমুসলিম ব্যবসায়ীদেরও বাণিজ্য পণ্যের ওপর কর আরোপ করা হবে যদি তাদের মূলধন ২০০ দিরহাম পর্যন্ত পৌছে অথবা তারা ২০ মিসকাল স্বর্ণের মালিক হয়ে যায়। এ কথা সত্য যে, ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ অমুসিলম ব্যবসায়ীদের ওপর বাণিজ্যের শতকরা ৫ ভাগ এবং মুসলিম ব্যবসায়ীদের উপর আড়াই ভাগ কর আরোপ করেছিলেন। তবে এ কাজটা কুরআন বা হাদীসের কোনো সুস্পষ্ট বাণীর আলোকে করা হয়নি। এটা তাদের ইজতিহাদ বা গবেষণালদ্ধ সিদ্ধান্ত ছিল। এটা সমকালীন পরিস্থিতির চাহিদা অনুসারে করা হয়েছিল। সে সময় মুসলমানদের অধিকাংশই দেশরক্ষার কাজে নিয়োজিত ছিলেন এবং সমস্ত বাবসায়-বাণিজ্য অমুসলিমদের হাতে চলে গিয়েছিল। এজন্য মুসলিম ব্যবসায়ীদের উৎসাহ বৃদ্ধি এবং তাদেরকে ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য তাদের ওপর কর কমিয়ে দেয়া হয়েছিল।
সামরিক চাকুরী হতে অব্যাহতি পাওয়ার অধিকার
অমুসলিমগণ সামরিক দায়িত্বমুক্ত। শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা এককভাবে শুধু মুসলিমদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। কারণ একটা আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কেবল তারাই উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যারা ঐ আদর্শকে সঠিক বলে মানে। তাছাড়া লড়াই চলাকালে নিজেদের আদর্শ ও মূলনীতি মেনে চলাও তাদের পক্ষেই সম্ভব। অন্যরা দেশ রক্ষার জন্য লড়াই করলে ভাড়াটে সৈন্যের মতো লড়বে এবং ইসলামের নির্ধারিত নৈতিক সীমা রক্ষা করে চলতে পারবে না। এজন্য ইসলাম অমুসলিমদের সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে এবং কেবল দেশ রক্ষার কাজে ব্যয় নির্বাহে মুসলিমদের অংশগ্রহণকে কর্তব্য বলে গণ্য করেছে। এটাই জিযিয়ার আসল তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য। এটা শুধু যে আনুগত্যের প্রতীক তা নয় বরং সামরিক কর্মকান্ড থেকে অব্যাহতি লাভ ও দেশ রক্ষার বিনিময়ও বটে। এজন্য জিযিয়া শুধু যুদ্ধ করতে সক্ষম পুরুষদের ওপরই আরোপ করা হয়। আর কখনো যদি মুসলিমগণ অমুসলিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অক্ষম হয়, তাহলে জিযিয়ার টাকা ফেরত দিতে হবে। ইয়ারমুকের যুদ্ধে যখন রোমানরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশাল
সমাবেশ ঘটালো এবং মুসলমানরা সিরিয়ার সকল বিজিত এলাকা পরিত্যাগ করে একটি কেন্দ্রে নিজেদের শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে বাধ্য হলো, তখন হযরত আবু উবাইদা নিজের অদীসস্থ সেনাপতিদের নির্দেশ দিলেন, তোমরা যেসব জিযিয়া ও খাজনা অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করেছিলে তা তাদের ফিরিয়ে দাও এবং, বল, "এখন আমরা তোমাদের রক্ষা করতে অক্ষম, তাই যে অর্থ তোমাদের রক্ষা করার বিনিময়ে আদায় করেছিলাম তা। ফেরত নিচ্ছি"।
এই নির্দেশ মুতাবিক সকল সেনাপতি আদায় করা অর্থ ফেরত দিলেন। এ সময় অমুসলিম নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করে ঐতিহাসিক বালাযুরী লিখেছেন, মুসলমান সেনাপতিগণ যখন সিরিয়ার হিমস নগরীতে জিযিয়ার অর্থ ফেরত দেন, তখন সেখানকার অধিবাসীবৃন্দ সমস্বরে বলে ওঠে, "ইতঃপূর্বে যে যুলুম অত্যাচারে আমরা নিষ্পেষিত হচ্ছিলাম, তার তুলনায় তোমানের শাসন ও ন্যায়বিচারকে আমরা বেশী পছন্দ করি। এখন আমরা যুদ্ধ করে পরাজিত হওয়া ছাড়া কোন মতেই হিরাক্লিয়াসের কর্মচারীদেরকে অআদের শহরে ঢুকাতে দেব মা"
সাম্য ও সমতায় অধিকার
মৌলিক ও সামাজিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে ইসলামি রাষ্ট্রে মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে পার্থকা নেই। ইসলামি আইনবিদগণ বলেছেন।
"আমাদের জন্য যেসব অধিকার তাদের জন্যও তাই এবং আমাদের উপর যেসব দায়িত্ব তাদের উপরও তাই।"
হযরত আলী (রা) বলেছেন:
"অমুসলিম নাগরিকরা জিযিয়া প্রদান করে এ জন্য যে, তাদের সম্পদ ও জীবন মুসলিম নাগরিকদের সম্পন ও জীবনের মত নিরাপদ হবে।"
অমুসলিম নাগরিকদের বিষয়ে মহানবী (স) যে ওসিয়ত করেছেন তার ভিত্তিতে ইসলামি আইনবিদগণ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, অমুসলিম নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধান ওয়াজিব এবং তাদেরকে কোনরূপ কষ্ট দেয়া সম্পূর্ণ হারাম। তিনি আরও বলেছেন, অমুসলিম নাগরিকদের যদি কেউ কষ্ট দেয়, একটি কটু কথাও বলে, তাদের অসাক্ষাতে তাদের ইজ্জতের উপর একবিন্দু আক্রমণও করে অথবা তাদের সাথে শত্রুতার ইন্ধন যোগায়, তাহলে সে আল্লাহ ও রাসূল (স) এর দ্বীন ইসলামের দায়িত্বকে লংঘন করল।
আল্লামা ইবনে হাজম-এর মতে যদি কোন বহিঃশক্তি মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিমদের হত্যা করতে এগিয়ে আসে তবে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে অমুসলিম নাগরিককে রক্ষা করা ইসলামি রাষ্ট্রের কর্তব্য।
নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার
ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকগণ তাদের নিজ নিজ ধর্মপালনের স্বাধীনতা ভোগ করবে। ইসলামের প্রখ্যাত শাসকবৃন্দ রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে অমুসলিম নাগরিকদের ধর্মশালা সংস্কার ও মেরামত করে গৌরবোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। পবিত্র কুরআনের ঘোষণা: لا إكراه في الدينর ব্যাপারে কোন জবরদস্তি নেই" এর মাধ্যমে অমুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করেছে।
আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার
মুসলিম নাগরিকের মত একজন অমুসলিম ও রাষ্ট্রীয় আইনের আশ্রয় প্রার্থনা করার অধিকার রাখে। ইসলাম ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমীর, ফকীর, শিক্ষিত, মুর্খ, মুসলিম, অমুসলিমদের মধ্যে কোন ভেদ রেখা টানেনি। স্বজনপ্রীতি অথবা গোত্র, বর্ণ, ধর্ম বিশেষের পক্ষপাতিত্ব করা সম্পূর্ণ হারাম করেছে। কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
"আর যদি বিচার নিষ্পত্তি কর তবে তাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করবে।" (সূরা আল-মায়েদা- ৪২)
যুদ্ধে অংশগ্রহন না করার অধিকার
অমুসলিমদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেয়া যাবে না। দেশ রক্ষার মত কঠিন দায়িত্ব থেকে তারা যুক্ত। কারণ এসব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যই তারা জিযিয়া প্রদান করে থাকে। অতএব জিযিয়া গ্রহণ করে তাদেরকে জিহাদে অংশ নেয়ার নির্দেশ দেয়া চুক্তি ভঙ্গের শামিল। ইসলামি রাষ্ট্রে যুদ্ধ ও দেশ রক্ষার দায়িত্ব মুসলিম নাগরিকগণ পালন করবেন।
আরও কতিপয় অমুসলিমদের বাড়তি অধিকার
উপরে অমুসলিমদের যে সব অধিকারের উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো তাদের জন্য শরীআতে নির্ধারিত। বর্তমান যুগে একটি ইসলামি রাষ্ট্র তার অমুসলিম নাগরিকদেরকে ইসলামি মূলনীতির আলোকে তী কী অতিরিক অধিকার দিতে পারে। নিম্নে তা আলোচিত হল।
রাষ্ট্র প্রধান বা আইন সভার সদস্য হওয়ার অধিকার
সর্ব প্রথম রাষ্ট্র প্রধানের প্রশ্নে আসা যাক। যেহেতু ইসলামি রাষ্ট্র একটা আদর্শবাদী রাষ্ট্র। ইসলামি রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব হল ইসলামের মূলনীতি অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। সুতরাং যারা ইসলামের মূলনীতিকেই মানে না. সে আর যাই হোক রাষ্ট্র প্রধানের পদে কোনক্রমেই অভিষিক্ত হতে পারে না। আর মজলিসে শূরা বা পার্লামেন্ট তথা আইন সভাকে যদি শতকরা একশো ভাগ খাঁটি ও নির্ভেজাল ইসলামি আদর্শ মুতাবিক গঠন করতে হয়, তাহলে এখানেও অমুসলিম প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নেই। তবে বর্তমান যুগের পরিস্থিতির আলোকে এর অবকাশ এই শর্তে সৃষ্টি করা যেতে পারে যে, দেশের সংবিধানে এই মর্মে সুস্পষ্ট নিশ্চয়তা থাকবে যে-
ক. আইন সভা কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না।
খ. দেশের আইনের সর্বপ্রধান উৎস হবে কুরআন ও সুন্নাহ।
গ. আইনের চূড়ান্ত অনুমোদনের কাজটি যে ব্যক্তি করবেন তিনি একজন মুসলিম হবেন।
তবে এরূপ একটি পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে যে, অমুসলিমদেরকে দেশের আইন সভার অন্তর্ভুক্ত করার পরিবর্তে তাদের জন্য একটা আলাদা প্রতিনিধি পরিষদ বা আইন সভা গঠন করে দেয়া যায়। এই পরিষদ দ্বারা তারা নিজেদের সামষ্টিক প্রয়োজনও মেটাতে পারবে এবং দেশের প্রশাসন সংক্রান্ত ব্যাপারেও নিজেদের দৃষ্টিভংগি তুলে ধরতে পারবে। এই পরিষদের সদস্যপদ এবং ভোটাধিকার শুধু অমুসলিমদের জন্যই সংরক্ষিত থাকবে এবং এখানে তাদের মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। এই পরিষদের মাধ্যমে তারা নিম্ন লিখিত কাজগুলো সমাধা করতে পারবে-
১ তারা নিজেদের পারিবারিক ও ধর্মীয় বিষয়ে আইন প্রণয়ন ও পূর্ব থেকে প্রচলিত সকল আইনের খসড়া রাষ্ট্র প্রধানের অনুমোদনক্রমে আইনে পরিণত করতে পারে।
২. তারা সরকারের প্রশাসনিক কর্মকান্ড ও মজলিসে শূরার সিদ্ধান্তসমূহ সম্পর্কে নিজেদের অভিযোগ, পরামর্শ ও প্রস্তাব অবাধে পেশ করতে পারবে এবং সরকার ন্যায়ের ভিত্তিতে তার পর্যালোচনা করবে।
৩. তারা আপন সম্প্রদায়ের স্বার্থ ও দেশের অন্যান্য ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পারবে। সরকারের একজন প্রতিনিধি তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্যও উপস্থিত থাকবেন।
পৌরসভা ও স্থানীয় সরকারের স্তরগুলোতে (Local bodies) অমুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ও ভোটদানের পূর্ণ অধিকার দেয়া যেতে পারে।
লেখার স্বাধীনতা
ইসলামি রাষ্ট্রে একজন মুসলিম যেমন বাক স্বাধীনতা, সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা এবং মতামত ও বিবেকের স্বাধীনতা ভোগ করে, অমুসলিমরাও অনুরূপ স্বাধীনতা ভোগ করবে। এ ব্যাপারে যেসব আইনগত বিধিনিষেধ মুসলমানদের ওপর থাকবে, তা তাদের ওপরও থাকবে।
আইন সংগতভাবে তারা সরকার, সরকারী আমলা এবং স্বয়ং সরকার প্রধানেরও সমালোচনা করতে পারবে। ধর্মীয় আলোচনা ও গবেষণার যে স্বাধীনতা মুসলমানদের রয়েছে, তা আইন সংগতভাবে তাদেরও থাকবে। একজন অমুসলিম যে কোন ধর্ম গ্রহণ করলে তাতে সরকারের কোন আপত্তি থাকবে না। তবে কোন মুসলিম ইসলামি রাষ্ট্রের সীমারেখায় থাকা অবস্থায় আপন ধর্ম পরিবর্তন করতে পারবে না।
অমুসলিমদেরকে তাদের বিবেকের বিরুদ্ধে কোন চিন্তা ও কর্ম অবলম্বনে বাধ্য করা যাবে না। দেশের প্রচলিত আইনের বিরোধী নয় এমন যে কোন কাজ তারা আপন বিবেকের দাবী অনুসারে করতে পারবে।
শিক্ষার অধিকার
ইসলামি রাষ্ট্র গোটা দেশের জন্য যে শিক্ষা বাবস্থা চালু করবে, তাদেরকে সেই শিক্ষা ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু ইসলামের ধর্মীয় পুস্তকাদি পড়তে তাদেরকে বাধ্য করা যাবে না। দেশের সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠনে অথবা নিজেদের বিশেষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপন ধর্ম শিক্ষার আলাদা ব্যবস্থা করার পূর্ণ স্বাধীনতা তাদের থাকবে।
চাকুরী পাওয়ার অধিকার
কতিপয় সংরক্ষিত পদ ছাড়া সকল চাকুরীতে তাদের প্রবেশাধিকার থাকবে এবং এ ব্যাপারে তাদের সাথে কোন বৈষম্য করা চলবে না। মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের যোগ্যতার একই মাপকাঠি হবে।
অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অধিকার
শিল্প, কারিগরি, বাণিজ্য, কৃষি ও অন্য সব পেশার দ্বার অমুসলিমদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এসব ক্ষেত্রে মুসলমানরা যে সুযোগ ভোগ করে থাকে, তা অমুসলিমরাও ভোগ করতে পারবে এবং মুসলিমদের উপর আরোপ করা হয় না এমন কোন বিধিনিষেধ, অমুসলিমদের উপরও আরোপ করা যাবে না। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে তৎপরতা চালানোর সমান অধিকার থাকবে।
অমুসলিম নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য
নাগরিকের প্রদত্ত এসব অধিকারের বিপরীতে ইসলামি রাষ্ট্রে সরকারের ব্যাপারে অমুসলিমদের যে দায়িত্ব-কর্তব্যগুলো রয়েছে তা নিম্নরূপ-
সরকারের আনুগত্য করা
ইসলামি রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিকের অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে সরকারের আনুগত্য করা। যে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত নয় সে নাগরিক হতে পারে না। এ সম্পর্কে পরিস্কার ভাষায় নবী করীম (স) বলেছেন: "শ্রবণ করা, অনুসরণ করা ও মেনে চলা সকল অবস্থায় অপরিহার্য।" অর্থাৎ কোন আইন পছন্দ হোক বা অপছন্দনীয় হোক, সহজসাধ্য হোক বা কষ্টসাধ্য হোক তা মান্য করা এবং পালন করা অপরিহার্য।
আইন-শৃংখলায় ফাটল ধরাবে না
ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রে শাসন-শৃংখলা বিরোধী এমন কোন কাজ করবে না যাতে রাষ্ট্রের শাসন-শৃংখলায় ফাটল ধরে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনেও এসেছে।
"পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।" (সূরা আল-আরাফ: ৫৬)
ভাল কাজে সহযোগিতা করা
ইসলামি রাষ্ট্রে অমুসলিম নাগরিকের কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা করা। অসৎ ও অকল্যাণকর কাজে বাধা দেয়া। কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে-
"সৎ কাজও তাকওয়ায় তোমরা পরস্পর সাহায্য করবে এবং পাপ ও সীমালংঘনে একে অন্যের সাহায্য করবে না।" (সূরা আল-মায়েদা :২)
জিযিয়া প্রদান করা
ইসলামি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নির্ধারিত জিযিয়া প্রদান করা অমুসলিম নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তবে তাদের প্রতি কঠোরতা প্রয়োগ করতে নবী করীম (স) নিষেধ করেছেন। হযরত উমর (রা)-এর নির্দেশ ছিল "যে পরিমাণ সম্পদ রাষ্ট্রকে প্রদান করা তাদের সামর্থ্যের বাইরে তা দিতে তাদেরকে বাধ্য করা যাবে
"যে ব্যক্তি ইসলামি রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিককে কোন রূপ কষ্ট দেবে। আমি নিজেই তার বিপক্ষে দাঁড়াব এবং আমি যার বিরুদ্ধে দাঁড়াব কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে আমি মামলা দায়ের করব।" (আল-হাদীস)
সর্বদা রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনা করা
মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক যারা আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি বা সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হয়ে মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাস করছে রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনা করা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। রাষ্ট্রের মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন হয় এমন কোন কাজ তারা করতে পারবে না।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মুসলিম নাগরিক ও অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে কতিপয় পার্থক্য ছাড়া মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। অতএব কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে মুসলিম অমুসিলম সকলেই সমান।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url