মুসলিম নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য
মুসলিম নাগরিকের বিভিন্ন অধিকার সম্পর্কে বর্ণনা দিতে পারবেন, মুসলিম নাগরিকের বিভিন্ন কর্তব্য সম্পর্কে বলতে পারবেন। ইসলামি রাষ্ট্রে মুসলিম নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যকে আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করব। যেমন-
বেঁচে থাকার অধিকার
ইসলামি রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের বাঁচার অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত। কোন ব্যক্তি, সংঘ, সংগঠন, বহিঃশক্তি অথবা স্বয়ং রাষ্ট্র কোন নাগরিককে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে উদ্যত হলে ইসলামি রাষ্ট্র তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়।
ইসলামি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা যে কোন মূল্যে নিশ্চত করে। আল্লাহ তা'আলা এ প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছেন:
"আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করোনা।" (সূরা বনী ইসরাঈল :৩৩)
মহানবী (স) তাঁর বিদায় হজ্বের ভাষণে ঘোষণা করেছেন-
"তোমাদের প্রত্যেকের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরু তোমাদের পরস্পরের কাছে পূতঃপবিত্র।” (বুখারী)
মুসলিম মনীষীদের মত হচেছ, রাষ্ট্রীয় উদাসীনতার কারণে কারো মৃত্যু হলে তা হত্যা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
বস্ত্রের অধিকার
বস্ত্র দ্বারা মানুষ তার আক্র রক্ষা করে। ইসলামি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের এ মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। বস্ত্র, পশু ও মানুষের মধ্যে ভেদ রেখা টেনে দেয়। এ উপকরণটি ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এর ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
বাসস্থানের অধিকার
বাসস্থান মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। ইসলামি রাষ্ট্রে সকল নাগরিকের নিরাপদে আপন আপন বাসস্থানে বসবাস করার অধিকার সংরক্ষিত। নাগরিকগণ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হওয়ার শর্তে দেশের যে কোন স্থানে বসবাস করার অধিকার রাখে। রাষ্ট্র এর ব্যবস্থা করবে।
চিকিৎসার অধিকার
ইসলামি রাষ্ট্রে কোন নাগরিক অসুস্থ, রোগাক্রান্ত বা দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে আহত হয়ে পড়লে চিকিৎসা ও সেবা লাভের মৌলিক অধিকার রাখে। রাষ্ট্র তার চিকিৎসার সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে বাধ্য। এজন্য জনকল্যাণের জন্য প্রচুর পরিমাণ সরকারী হাসপাতাল ও চিকিৎসালয় স্থাপন করা ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
শিক্ষার অধিকার
ইসলাম শিক্ষাকে প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরয করে দিয়েছে। শিক্ষা ছাড়া যেমন পূর্ণাঙ্গ মুসলমান হওয়া যায় না অনুরূপভাবে কোন উন্নতিও সাধন করা যায় না। ইসলামের দর্শনকে বুঝতে হলে শিক্ষার প্রয়োজন। মুসলমানদেরকে প্রার্থিতা ছাড়াই নেতা নির্বাচন করতে হয়। শিক্ষা ব্যতীত একজন নাগরিকের পক্ষে এ গুরুদায়িত্ব পালন করা অসম্ভব। এজন্য ইসলামি রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের জন্য শিক্ষা সুলভ করবে যাতে ব্যাপক শিক্ষিত নাগরিক ইসলামি রাষ্ট্রের আদর্শকে অনুধাবন করতে পারে। আর-এর ফলে দেশ ও জাতির ভিত মজবুত হবে এবং জ্ঞান গরিমায় মুসলিম উম্মাহ আল্লাহর ঘোষণা মত শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
আরো পড়ুন: ইসলামি রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা
সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার অধিকার
ব্যক্তির, জীবন ও সম্পদ রক্ষা করাই রাষ্ট্রের একমাত্র কর্তব্য নয়। সেই সঙ্গে মান-মর্যাদা রক্ষা করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মুসলিম মানেই সম্মানিত, কেননা পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছেঃ "মান-ইজ্জত সবই আল্লাহ, রাসূল এবং সকল মুমিনদের জন্য।" অতএব কেউ অপমানিত হোক ইসলামি রাষ্ট্র তা কিছুতেই বরদাশত করতে পারে না।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
"হে মুমিনগণ। কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে। কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকে যেন উপহাস না করে; কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের দোষারোপ করেনা এবং তোমরা একে অপরকে মন্দনামে ডেক না, ঈমানের পর মন্দ নাম অতি মন্দ। যারা তাওবা করেনা তারাই যালিম।" (সূরা আল হুজুরাত : ১১)
সম্পদ সঞ্চয় ও ভোগ করার অধিকার: মুসলিম রাষ্ট্রের নাগরিক তার বৈধ উপায়ে উপার্জিত সম্পদ ভোগ ও সংরক্ষণ করার অধিকার রাখে। সম্পদ উপার্জন ও ব্যয়ে আল্লাহর বিধান মেনে যে কোন পরিমাণ সম্পদ সঞ্চয় করা যায়। নাগরিকের এ বৈধ সম্পদ ভোগ ও সঞ্চয়ে কোন ব্যক্তি, সংঘ, সংগঠন অথবা অন্য কোন শক্তি বাধা সৃষ্টি করলে অথবা হরণের চেষ্টা করলে তা রক্ষা করা ইসলামি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পবিত্র কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে:
তোমরা নিজেদের মধ্যে একে অন্যের অর্থসম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।" (সূরা আল-বাকারা: ১৮৮) "
ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার
ইসলামি রাষ্ট্র ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সংরক্ষণ করে তবে রাষ্ট্র বা অন্য কোন নাগরিকের কাজে বিঘ্ন ঘটায় এমন স্বাধীনতা ইসলাম বৈধ মনে করে না। ব্যক্তি স্বাধীনতা একটি ব্যাপক বিষয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ব্যক্তি স্বাধীনতা বলতে বুঝায়, নাগরিকদের স্বাধীন, অবাধ চলাফেরা, শত্রুর শত্রুতা থেকে আত্মরক্ষা, সম্পদ সংরক্ষণ, অকারণে অত্যাচারিত, না হওয়ার অধিকার ভোগ করা। ইসলামি রাষ্ট্রেও উপরোক্ত অর্থে ব্যক্তি স্বাধীনতা পূরো মাত্রায় স্বীকৃত। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা হানি হয় কিনা সেদিকে বিশেষভাবে ইসলামি রাষ্ট্রকে লক্ষ্য রাখতে হয়। কোনভাবে একজনের অপরাধ অন্যের উপর চাপানো যাবে না। বিচারের যথাযথ প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করে কাউকে যেন শাস্তি দেয়া না হয় সেদিকে রাষ্ট্রকে প্রখর দৃষ্টি রাখতে হয়। কেননা কুরআনের নির্দেশ হচ্ছেঃ "একজনের বোঝা অপরজন কখনো বহন করবে না।" (সূরা আল-ফাতের: ১৮)
আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার
ইসলামের সাম্যনীতির অন্যতম ক্ষেত্র হচ্ছে আইন। ইসলামি রাষ্ট্রে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে এক নজীরবিহীন সাম্য নীতি অনুসৃত হয় কোন নাগরিক যদি মনে করে যে, কোন ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, কর্তৃপক্ষ বা আমলা এমনকি স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান তার ন্যায্য অধিকার খর্ব করছে, অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে বা তার উপর যুলুম করছে, তবে সে-এর প্রতিকারের জন্য আদালতের আশ্রয় নিতে পারে। আদালত নিরপেক্ষভাবে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তার প্রতিকার করতে বাধ্য। অভিযোগ যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে। পবিত্র কুরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশ:
"যখন তোমরা কথা বলবে, তখন ন্যায্য বলবে স্বজনের সম্পর্কে হলেও।" (সূরা আল-আনআম : ১৫২)
ইসলামি রাষ্ট্রে নাগরিকের আইনের আশ্রয় ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি সম্পর্কিত বহু ঘটনা মহানবী (সা.), খোলাফায়ে রাশেদীন এবং পরবর্তী যুগের অনেক মুসলমান শাসকের জীবনে দেখা যায়। ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তার উপরই শ্রেণী বৈষম্যহীন ইসলামি সমাজ দাঁড়িয়ে আছে।
আরো পড়ুন: ইসলামি রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থা
বাক স্বাধীনতার অধিকার
এ অধিকার পৃথিবীর কোথাও নিঃশর্ত ও নিরঙ্কুশ নয়। কারো কথা যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম অথবা অন্য ব্যক্তির ন্যায্য অধিকারকে ক্ষুণ্ণ না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে তার বাক স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। ইসলামি রাষ্ট্রে সত্য ও ন্যায্য কথা বলা নাগরিকের শুধু অধিকার নয়, কর্তব্যও বটে। মহানবী (সঃ) এ মর্মে বাণী প্রদান করেছেন:
"যে সত্য ও ন্যায্য কথা বলে না সে বোবা শয়তান।"
সুতরাং ইসলামি রাষ্ট্রে ব্যক্তি তার ন্যায্য কথা, ন্যায় সঙ্গত সমালোচনা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করে।
সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার
কোন সৎ ও মহৎ উদ্দেশ্যে ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিকগণ সংঘবদ্ধ হওয়ার অধিকার রাখে। রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করার অধিকার রাখে না। পবিত্র কুরআনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ দিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে।
"তোমরা একতাবদ্ধ হয়ে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারু কর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।" (সূরা আলে-ইমরান :১০৩)
ইসলামি রাষ্ট্রের নাগরিকগণ পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে সত্য ন্যায় ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে আত্মনিয়োগ করবে এটা মহান আল্লাহরই ইচ্ছা। কাজেই আল্লাহর এ ইচ্ছাকে ইসলামি রাষ্ট্র বাস্তবে পরিণত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করবে।
চলা-ফেরার অধিকার
ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুন্ন না করে ইসলামি রাষ্ট্রের যে কোন মুসলিম নাগরিক দেশের মধ্যে অবাধে বিচরণ করতে পারবে। এ চলাচলের অধিকার একটি অন্যতম সামাজিক অধিকার, যার মাধ্যমে ব্যক্তির সাথে সমাজের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। শুধু তাই নয় শরীআত এ ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করেছে। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে:
"তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করেনি এবং তাদের পূর্ববর্তীদের কি পরুিাম হয়েছিল তা কি দেখেনি?” (সূরা ইউসুফ: ১০৯)
তাছাড়া ব্যবসায়িক কাজে বিদেশ ভ্রমণের কথাও পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ইসলামি রাষ্ট্রে নাগরিকের চলাফেরার অধিকার স্বীকৃত। তার এ অধিকার সংরক্ষণের দায়িত্বও রাষ্ট্রের উপর কর্তব্য।
মত প্রকাশের অধিকার
অন্যতম একটি নাগরিক অধিকার হচ্ছে, মত প্রকাশের অধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার। হযরত আলী (রা) বিষয়টি সম্পর্কে ইসলামি আইনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। তাঁর খিলাফত আমলে খারিজী সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় হয়েছিল। বর্তমানকালের নৈরাজ্যবাদী দলসমূহের সাথে তাদের অনেকটা সামঞ্জস্য ছিল। আলী (রা)-এর খিলাফতকালে তারা প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের অস্তিত্বই অস্বীকার করত এবং অস্ত্রবলে এর অস্তিত্ব বিলোপের জন্য বদ্ধপরিকর ছিল। আলী (রা) এ অবস্থায় তাদেরকে নিম্নোক্ত পয়গাম পাঠান:
"তোমরা যেখানে ইচ্ছা বসবাস করতে পার। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে এ চুক্তি রইল যে, তোমরা রক্তপাত করবে না, ডাকাতি করবে না এবং কারও উপর যুলুম করবে না।" (নায়লুল আওতার, ৭ম খন্ড, পৃঃ ১৩০)
অপর এক জায়গায় তিনি তাদের বলেন-
"তোমরা যতক্ষণ বিপর্যয় ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তোমাদের আক্রমণ করব না।" (নায়লুল আওতার, ৭ম খন্ড পৃঃ ১৩৩)
উপরোক্ত বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, কোন দলের মতবাদ যাই হোক না কেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের মত যেভাবেই প্রকাশ করুক না কেন, ইসলামি রাষ্ট্র তাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না। কিন্তু তারা যদি নিজেদের মত শক্তি প্রয়োগ করে বাস্তবায়ন করতে চায় এবং রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা চূর্ণ বিচূর্ণ করার চেষ্টা করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
ভোট দেয়ার অধিকার
যেহেতু ইসলামি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক প্রকৃতির, সেহেতু দেশের শাসক নির্বাচনে জনগণ ভোটদানের অধিকার ভোগ করে থাকে। মহানবী (স)-এর ইনতিকালের পর খোলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচনের সময় মুসলিম নাগরিকগণ তাদের সমর্থন ব্যক্ত করার মাধ্যমে ভোটদানের অধিকার প্রয়োগ করেছিল। খিলাফতের ভিত্তি রচিত হয়েছিল নাগরিকদের ভোটাধিকার বা সমর্থন তথা অসমর্থনের ইচ্ছা ব্যক্ত করার মাধ্যমে। অতএব ইসলামি রাষ্ট্রে সকল প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি ভোটদানের অধিকার রাখে।
নেতৃত্ব দানের অধিকার
ভোটের মাধ্যমে বা অন্য যে কোন উপায়ে জনমতের সমর্থনে নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার নাগরিকদের রয়েছে। এখানে নেতৃত্ব প্রার্থনা করার রেওয়াজ না থাকলেও যে কোন নাগরিক তার সদগুণাবলী ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জনগণের সমর্থন লাভ করে তাদের নেতৃত্বদানের অধিকার রাখে। এ জন্য মহানবী (স) একজন ক্রীতদাসের নেতৃত্বও মেনে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বর্ণ, গোত্র, আভিজাত্য ইত্যাদিকে প্রাধান্য দেয়া হয় না বলে ইসলামি রাষ্ট্রে নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার সর্বজনীন।
রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার
দেশ ও জনগণের হিতার্থে নাগরিকগণ রাজনৈতিক দল গঠন করতেৎপারে। ন্যায়সঙ্গত দাবী আদায়, ন্যায্য সমালোচনা এবং সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নাগরিক নাগরিকগণ সংঘবদ্ধ হয়ে দলগঠন করতে পারে। তবে যে কোন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী ইসলাম অনুমোদিত বিধি-বিধানের ভিত্তিতে রচিত হতে হবে। মানুষের মনগড়া রাজনৈতিক মতবাদ ইসলামি রাষ্ট্রে অচল। মনে রাখতে হবে, ইসলামি রাষ্ট্রের কাজ হচেছ খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলের সুন্নাহ প্রতিষ্ঠা করাই একমাত্র উদ্দেশ্য। কারণ মানুষের সার্বিক কল্যাণ আল্লাহর বিধান ও মহানবী (স) -এর পদ্ধতির মধ্যে নিহিত।
গোপনীয়তা সংরক্ষণের অধিকারঃ প্রত্যেক নাগরিক ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা সংরক্ষণের অধিকার রাখে। যেমন এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
"তোমরা নিজেদের ঘর ব্যতীত অপর কারো ঘরে গৃহবাসীদের অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করো না।" (সূরা আন-নুর : ২৭) অন্য আয়াতে এসেছে "তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না।" (সূরা আল-হুজুরাত :১২)
আরো পড়ুন: অমুসলিম নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য
যুলুমের বিরুদ্ধাচরণ করার অধিকার
যুলুমের বিরুদ্ধে আওয়ায় তোলার অধিকার। যেমন এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী-
"মন্দ কথার প্রচারা আল্লাহ পছন্দ করেন না, তবে যার উপর যুলুম করা হয়েছে।" (সূরা আন-নিস: ১৪৮)
অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণ করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের অন্যায় থেকে নিবৃত্ত করার অধিকার, সমালোচনার স্বাধীনতার অধিকারও এর পর্যায়ভুক্ত। হাদীসে এসেছে-
"তোমাদের কেউ অন্যায় কাজ করতে দেখলে হাত দ্বারা ফিরাবে, সম্ভব না হলে মুখ দ্বারা ফিরাবে, তা সম্ভব না হলে মনে মনে পরিকল্পনা করবে আর এটি ঈমানের দুর্বলতম অংশ।"
কুরআনে এসেছে-
"তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মাত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে, তোমরা সৎ কাজের নির্দেশ দেবে, অসৎ কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবে।" (সূরা আলে-ইমরান: ১১০)
কোন বিষয় বিশ্বাসের স্বাধীনতার অধিকারঃ কোন মতামত গ্রহণ করতে কাউকে বাধ্য করা যাবে না। তাকে স্বাধীনতা দিতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন:
"দ্বীনের ব্যাপারে কোন যবরদস্তি নেই।" (সূরা আল-বাকারা: ২৫৬)
অন্য আয়াতে বলেন:
"তবে কি তুমি মুমিন হবার জন্য মানুষের উপর জবরদস্তি করবে?" (সূরা ইউনুস: ৯৯)
অভাবমুক্ত হওয়ার অধিকারঃ অভাবী এবং বঞ্চিত ব্যক্তিদেরকে তাদের জীবন ধারণের অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রী অর্জনের অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্র বা ধনী ব্যক্তিরা তার এ অধিকার পূরণ করবে যেমন আল্লাহর বাণী
"এবং তাদের সম্পদে সাহায্য প্রার্থী ও বঞ্চিতের অধিকার রয়েছে।" (সূরা আয-যারিয়াত: ১৯)
রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের কর্তব্য
রাষ্ট্রের নাগরিক শুধু অধিকারই ভোগ করে না। তাকে বেশ কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হয়। রাষ্ট্র নাগরিকদের নিয়েই গঠিত হয়। অতএব নাগরিকদের অধিকারের সাথে কর্তব্যও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিম্নে নাগরিকের দায়িত্বগুলো সংক্ষেপে আলোচিত হলো।
আনুগত্য স্বীকার করা
নাগরিক হওয়ার প্রথম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা। যে রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত নয় সে নাগরিক হতে পারে না। নাগরিকগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য নেতা নির্বাচন করেন। নেতা জনসমর্থনের ভিত্তিতে ক্ষমতায় সমাসীন হন। তিনি ইসলামের বিধি-বিধান মত শাসন পরিচালনা করলে নাগরিকগণ তার প্রতি অনুগত থেকে রাষ্ট্র সমাজ পরিচালনায় তাকে সহযোগিতা করবে। পবিত্র কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
"তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর, আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা ক্ষমতার অধিকারী।" (সূরা আন-নিসা : ৫৯)
আইন মান্য করা
নাগরিকের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রের আইন মেনে চলা। ইসলামি রাষ্ট্রের আইন হচ্ছে ইসলামি নির্দেশ। এ নির্দেশ অমান্য করা প্রকারান্তরে ইসলামকে অমান্য করার শামিল। আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের পূর্বশর্ত আইন মেনে চলা। মহানবী (স) এ মর্মে বাণী প্রদান করেছেন:
"সুখে-দুঃখে ও আনন্দে-নিরানন্দে রাষ্ট্রপ্রধানের হুকুম আহকাম শ্রবণ করা ও মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য।" যতক্ষণ পর্যন্ত দেশের আইন শরীআ পরিপন্থী না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নাগরিক আইন মেনে চলতে বাধ্য। ইসলাম বিরোধী আইন প্রণীত হলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। কেননা ইসলামের নির্দেশ হচ্ছে:
"আল্লাহর নাফরমানীর আওতায় পড়ে এমন কোন কাজে অন্যের আনুগত্য স্বীকার করা যাবেনা।"
রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত না হওয়া
ইসলামি রাষ্ট্রে নাগরিকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত না হওয়া। প্রতিটি নাগরিক যে রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে তার সুখ ও সমৃদ্ধির স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রয়াসী হয় এবং যে নাগরিক রাষ্ট্রে বসবাস করে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত হয় সে সুনাগরিক নয় বরং রাষ্ট্রদ্রোহী। রাষ্ট্রদ্রোহিতা জঘন্য অপরাধ। কেননা এ কাজ সমাজ-জীবনকে অস্থিতিশীল ও জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। পবিত্র কুরআনে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মত জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
"পৃথিবীতে স্তি স্থাপনের পর তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।" (সূরা আল-আরাফ: ৫৬)
রাষ্ট্রদ্রোহিতা ইসলামের দৃষ্টিতে মহাপাপ। এ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন:
"এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেওনা। আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের ভালবাসেন না। "(সুরা আল-কাসাস: ৭৭)
সৎকাজে সহযোগিতা ও অসৎকাজে বাধাদান করাঃ মুসলমান হিসেবে সৎ ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা করা এবং অসৎ ও অকল্যাণকর কাজে বাধা দেয়া প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব। নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্র তথা সরকার কর্তৃক গৃহীত শুভ উদ্যোগে সহায়তা করা। অসৎ অশুভ কাজে বাধাদান করা।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url