যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর মর্যাদা ও ক্ষমতার তুলনা

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মর্যাদা ও ক্ষমতার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করা হয়েছে।

ভূমিকা 

সাম্প্রতিক কালের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের দুই দিক পাল হল আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। উভয়েই দু'টি শক্তিশালী রাষ্ট্রের কর্ণধার। এদিক থেকে দেখতে গেলে উভয়েই প্রভৃত ক্ষমতার অধিকারী। রাষ্ট্র ও সরকারের কর্ণধার হিসেবে তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্য পরিদৃষ্ট হয়।


নির্বাচনগত দিক দিয়ে

আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ভোটদাতাগণ কর্তৃক পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির নিয়োগ দুটো নির্বাচনের ফলের উপর নির্ভর করে।


ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হয়ে কমন্স সভার সদস্য হিসেবে থাকেন। পরে সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা নির্বাচিত হলে রাজা বা রানী কর্তৃক তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন। সুতরাং কার্যতঃ উভয়েই পরোক্ষভাবে জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হয়ে থাকেন ও উভয়ের নিয়োগ দু'টো নির্বাচনের উপর নির্ভর করে। অবশ্য নির্বাচন পদ্ধতি সম্পূর্ণ পৃথক।


লিখিত ও অলিখিত ক্ষমতা

আমেরিকার রাষ্ট্রপতির পদ শাসনতন্ত্র কর্তৃক সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্রপতি তাঁর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি লাভকরেছেন লিখিত সংবিধান থেকে, এবং সেই সঙ্গে কংগ্রেস প্রণীত আইন-কানুন এবং বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত থেকে।

শাসনতন্ত্র প্রদত্ত ক্ষমতার বলে রাষ্ট্রপতি নিরপেক্ষভাবে শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করেন।

অপরপক্ষে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও পদমর্যাদা প্রধানতঃ প্রচলিত রীতি-নীতি ও প্রথাগত বিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রধানমন্ত্রী সংখ্যাগরিষ্ট দলের সমর্থনের উপর নির্ভর করেই শাসনকার্য পরিচালনা করেন।


প্রকৃত ক্ষমতাধারী এবং নামসর্বস্ব ক্ষমতাধারী:

আমেরিকায় ব্রিটেনের রাজার মত কোন নিয়মতান্ত্রিক শাসক প্রধান না থাকায় রাষ্ট্রপতি আইনতঃ ও কার্যতঃ শাসন ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী। শুধুমাত্র প্রকৃত শাসন ক্ষমতা পরিচালনা করা ছাড়াও রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক ব্যাপারগুলোতেও তিনি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। অর্থাৎ তিনি একাধারে রাষ্ট্রপতি ও অন্যদিকে সরকার প্রধান।


ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত শাসন ক্ষমতার অধিকারী ও প্রয়োগকারী হলেও আইনতঃ রাজাই হলেন রাষ্ট্রের প্রধান কর্মসচীব। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে রাজাই প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। অর্থাৎ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র সরকার প্রধান।


আইন সভার ক্ষমতা প্রসঙ্গ:

আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আইন পরিষদের সদস্য নন। অনেকটা আইন সভার প্রভাবমুক্ত এবং আইনসভাও। অনুরূপভাবে শাসন কর্তৃপক্ষের প্রভাবমুক্ত। রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষভাবে আইন সভার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না। আয় ব্যয় সংক্রান্ত ব্যাপারেও তার প্রভাব অপেক্ষাকৃত কম। কি সাধারণ আইন প্রণয়নে, কি অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেস সভাকে তাঁর স্বমতে আনতে বাধ্য করতে পারেন না।


ব্রিটেনে প্রমানমন্ত্রী হলেন সংখ্যাগরিষ্ট দলের নেতা এবং দলের নেতা হিসাবে তিনি পার্লামেন্ট সভাকে পরিচালিত করে থাকেন। সাধারণ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে ও অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে মন্ত্রীপরিষদসহ প্রধানমন্ত্রী যে নীতি অবলম্বন করেন সাধারণতঃ কমন্স সভা তা অনুমোদন করে। কমপ সাভা মন্ত্রীপরিষদ কর্তৃক অনুসৃত নীতি সমর্থন না করলে প্রধানমন্ত্রী কমন্স সভা ভেঙ্গে দেয়ার ভীতি প্রদর্শন করে কমন্স সভাকে সমতে আনতে পারেন।


কার্যকাল:

আমেরিকার রাষ্ট্রপতির কার্যকাল শাসনতন্ত্র কর্তৃক নির্ধারিত। চার বছরের মধ্যে প্রেসিডেন্টকে ইমপিচমেন্ট (Impeachment) ব্যতীত অপসারণ কোনভাবেই সম্ভব নয়।


ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরের জন্য কমন্স সভার দ্বারা নির্বাচিত হয়ে থাকেন। কিন্তু পার্লামেন্ট সভার সাথে মত বিরোধ ঘটলে তার পদত্যাগ করার কারণ ঘটতে পারে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সর্বদা একদিকে যেরূপ পার্লামেন্ট সভার সাথে যথাসম্ভব মতৈক্য বজায় রাখতে হয়। অন্যদিকে তেমনি জনমত পরিবর্তনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। এ দিক থেকে দেখতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। তাঁকে আইন সভা বা জনমতের উপর এতটা নির্ভর করতে হয় না।


নিশ্চয়তা:

পদত্যাগ, মৃত্যু বা অপসারণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অনুপস্থিত হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট তার স্থলাভিষিক্ত হন এবং শাসন ব্যবস্থায় তেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয় না।


অপরদিকে ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে সমগ্র ক্যাবিনেটের পতন ঘটে এবং নতুন করে নির্বাচন ও ক্যাবিনেট গঠনের প্রয়োজন হয়।


শাসন ক্ষমতা:

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট একাধারে স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক। তিনি বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করেন এবং রাষ্ট্রদতগণকে নিয়োগ দান করে। তিনি যুদ্ধ ঘোষণা ও সন্ধি স্থাপন করতে পারেন ও চুক্তিবদ্ধ হয়ে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে নীতি নির্ধারণে প্রয়াসী হতে পারেন। অবশ্য এ সকল ক্ষমতা প্রয়োগের সময় তাঁকে সিনেটের অনুমোদন লাভ করতে হয়।


কিন্তু ব্রিটেনে এ সকল কাজ আইনতঃ রাজা বা রানীর নামে হলেও মূলতঃ প্রধানমন্ত্রীই তা করেন। শাসন সংক্রান্ত্র ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা অধিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারেন।


পদমর্যাদার দিক থেকে:

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে অধ্যাপক লাস্কি বলেন যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ব্রিটেনের রাজা অপেক্ষা কোন কোন বিষয়ে অধিক ক্ষমতা সম্পন্ন। তবে কিছু কিছু বিষয়ে কম ক্ষমতাসম্পন্ন। সাধারণঃ প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা উন্নততর হিসেবে পরিগণিত হন। কারণ তিনি কেবল শাসকই নহেন তিনি রাষ্ট্রপ্রধানও বটে। ব্রিটেনে ক্যাবিনেটের সদস্যরা প্রধানন্ত্রীর সহকর্মী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে তাঁরা প্রেসিডেন্ট এর অধীনস্থ কর্মচারী মাত্র।


জরুরি অবস্থাঃ

প্রেসিডেন্ট তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে অনেকটা স্বাধীন। কেননা তিনি কংগ্রেসের নিকট কোনরূপ দায়ী নন এবং বিপদকালে তিনি একনায়কের মত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে পারেন। কিন্তু ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তাঁর কার্যাবলী ও নীতির জন্য সর্বতোভাবে পার্লামেন্ট এর নিকট দায়ী থাকেন। বস্তুতঃ প্রধানমন্ত্রীর পদ অধিকতর দায়িত্বশীল।


দলীয় আনুগত্য বিষয়ে:

পার্লামেন্টারী প্রথা ও দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থায় দলীয় ব্যবস্থা অপরিহার্য। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজ দলের বিরুদ্ধে কাজ করতে অক্ষম। যদিও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জাতীয় স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য করে দলের নির্দেশকে উপেক্ষা করতে পারেন না।


দলের জন্যই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন। কমন্স সভার অধিকাংশের সমর্থন যতদিন প্রধানমন্ত্রী লাভ করতে সক্ষম হন ততদিন তিনি নিয়মতান্ত্রিক শাসনকর্তা হিসাবে কাজ করতে পারেন।


নির্বাচনী যোগ্যতা:

জন্মসত্রে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট-কে আমেরিকার নাগরিক হতে হবে। কমপক্ষে ১৪ বৎসর আমেরিকাতে বাস করতে হবে এবং বয়সসীমা অন্ততঃ পক্ষে ৩৫ বছর হতে হবে।


কিন্তু ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এর পদ কোন শর্তের দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। ভোটার হবার যোগ্যতা থাকলেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন।


সারকথাঃ

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উভয়েই পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হন এবং তারা শাসন বিভাগ পরিচালনা করেন। তথাপি পদের ক্ষমতা কার্যাবলী ও প্রভাব প্রতিপত্তির পার্থক্য সুস্পষ্ট বর্তমান। কারণ উভয়েই ভিন্ন শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url