ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার তুলনা

ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য নির্ণয় করতে পারবেন।

ভূমিকা 

আধুনিক যুগ গণতন্ত্রের যুগ। গণতান্ত্রিক সরকারের অপরিহার্য পূর্বশর্ত রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা। রাজনৈতিক দলই তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর প্রয়াস পায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন- উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দলীয় ব্যবস্থার সফল বিকাশ ঘটেছে। উভয় দেশের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় জীবনে এক গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের রাজনৈতিক দল ব্যবস্থার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনার প্রেক্ষিতে তাদের গঠন, প্রকৃতি, কার্যাবলী ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য উভয়ই পরিলক্ষিত হয়।


সাদৃশ্য:

ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে বহু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশেই রাজনৈতিক দলগুলোর বিরাট সংগঠন রয়েছে। সরকারী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে নিজ নিজ কর্মসূচী বাস্তবায়ন এবং ক্ষমতার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার জন্য তারা নির্দিষ্ট সময় অস্ত্রর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হতে সচেষ্ট হয়। উভয় দেশেই দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার ঐতিহ্য সুদীর্ঘকাল যাবৎ বিদ্যমান। ফলে উভয় দেশেই জনগণ ভিন্ন ভিন্ন নীতি ও নেতৃত্বের অনুসারী এমন দু'টি দলের মধ্যে কোন একটিকে পছন্দমত ভোট দান করতে পারে। অবশ্য উভয় দেশেই ছোট-খাট অন্যান্য দলও আছে। তবে তাদের বিশেষ কোন গুরুত্ব নাই। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের সংবিধানেই দলীয় ব্যবস্থার কোন উল্লেখ নাই। দলীয় ব্যবস্থা উভয় ক্ষেত্রেই প্রথার (convention) ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।


প্রথমতঃ

দলীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণের মাত্রার দিক দিয়ে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে সর্বাধিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ব্রিটেনের দল দু'টি যেমন সুসংঘবদ্ধভাবে স্তর বিন্যস্ত, যেমন স্থানীয় দলগুলো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বাধীন এবং দলীয় ব্যবস্থায় যেরূপ কঠোর নিয়মশৃংখলা আছে, যুক্তরাষ্ট্রের দল দু'টি সেভাবে সংগঠিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় ব্যবস্থায় বিভিন্ন স্তর, যথা- জাতীয়, রাজ্য ও স্থানীয় স্তরে থাকলেও রাজ্য ও স্থানীয় স্তরের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ নাই। অপর পক্ষে ব্রিটেনে দলীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রাধান্য ভোগ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দল দু'টির মধ্যে কর্মসূচী সম্পর্কে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করা যায় না। কিন্তু ব্রিটেনে দু'টি দলের কর্মসূচীও আদর্শের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।


দ্বিতীয়তঃ

ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলগুলো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলোর তুলনায় অনেক বেশী সুশৃঙ্খল। দলীয় সদস্যগণের মধ্যে দৃঢ় শৃঙ্খলাবোধ নিশ্চিত করার মত শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের কোন দলের কেন্দ্রীয় সংগঠনেরই নাই। দলীয় সদস্যগণ সংশ্লিষ্ট দলের স্থানীয় সংগঠনের উপরই নির্ভরশীল এবং সেই সংগঠন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করতে পারে বা ক্ষেত্র বিশেষ জাতীয় প্রশ্নে উদাসীনও থাকতে পারে। পক্ষান্তরে, ব্রিটেনে রাজনৈতিক ব্যবস্থাতে দলীয় শৃঙ্খলা ও সংহতি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। কোন ব্যক্তিকে নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে তাঁকে তাঁর দলের সংগঠন, কর্মসূচী ও সর্বোপরি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপর নির্ভর করতে হয়। গুরুত্বপর্ণ বিষয়ে তিনি দলীয় নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ভোট দান করতে পারেন না, কারণ তা হলে তিনি পরবর্তী নির্বাচনে তাঁদের সমর্থন হারাবেন।


তৃতীয়তঃ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য পদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট শিথিলতা দেখা যায়। কোন দলের সদস্য পদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করার কিংবা দলের সপক্ষে কাজ করার কোন বাধ্যবাধকতা নাই। ফলে খুব কমসংখ্যক সদস্যই আনুষ্ঠানিকভাবে কোন দলের সদস্য হন। অপরপক্ষে, ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য পদের দৃঢ় ভিত্তি রয়েছে। দলীয় সদস্য হতে হলে কোন সদস্যকে দলের প্রতি অনুগত থাকার প্রতিশ্রুতি দান পূর্বক সদস্য পদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করতে হয়। প্রত্যেক দলীয় সদস্য সংশ্লিষ্ট দলের সপক্ষে কাজ করতে বাধ্য থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দলের সদস্য ও সমর্থকের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্দেশ করা যায় না। কিন্তু ব্রিটেনে দলীয় সদস্য ও সমর্থকের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষণীয়।


চতুর্থতঃ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোটার নির্দলীয়, অর্থাৎ কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। আবার রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট হলেও অনেকের আনুগত্য বেশ ক্ষণস্থায়ী তারা আজ এ দলের এবং কাল ঐ দলের সমর্থক হতে দ্বিধা করে না। আর তাই মার্কিন নির্বাচকদের (voter) মোটামুটিভাবে দল-নিরপেক্ষ (Non-partisan) বলা যায়। কিন্তু, ব্রিটেনে নির্দলীয় নির্বাচক বা প্রার্থীর সন্ধান পাওয়া দুস্কর। অবশ্য সেখানে কিছু কিছু ভাসমান নির্বাচক (Floating voters) আছে, তবে তাদের সংখ্যা নিতান্ত্রই নগণ্য।


পঞ্চমত:

ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় নেতার তুলনায় অধিকতর কর্তৃত্ব (authority) ভোগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক ব্যবস্থার শীর্ষে অবস্থান করেন রাষ্ট্রপতি এবং তার নির্বাচন প্রক্রিয়াও সম্পর্ণ স্বতন্ত্র। ব্রিটেনেও প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রত্যক্ষভাবে ভোটদান করা সাধারণ নাগরিকের পক্ষে অসম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর জন্য ভোট প্রদানের একমাত্র উপায় দল তাঁর নেতৃত্বাধীন দলের স্থানীয় পার্লামেন্টারী প্রার্থীর সপক্ষে ভোট দান করা। স্থানীয় প্রার্থীর ব্যক্তিত্বের তুলনায় দলীয় নেতার ব্যক্তিত্বই এক্ষণে ভোটারগণকে বেশী আকৃষ্ট করে যার মাধ্যমে দলীয় নেতার কর্তৃত্বই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।


সারকথাঃ

ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলগুলোর শ্রেণী-ভিত্তি যথেষ্ট সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে তা ঘটে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যেক দলই সকল শ্রেণীর ব্যক্তির স্বার্থের প্রতিফলন ঘটিয়ে কর্মসূচী প্রণয়ন করে এবং সমাজের কোন বিশেষ শ্রেণীর প্রতি আনুষ্ঠানিক আনুগত্য প্রদর্শন করে না। সেখানে দলগুলোর মধ্যে মতাদর্শগত কোন পার্থক্য দেখা যায় না। কিন্তু, ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণভাবে নির্দিষ্ট আদর্শ পোষণ ও অনুসরণ করে থাকে। সমাজের নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের প্রতি ব্রিটিশ দলগুলোর সাধারণ আবেদন বিদ্যমান বিধায় তাদের শ্রেণী ভিত্তিক সমর্থনও রয়েছে। বলা হয় যে, ব্রিটেনের দল দু'টির মধ্যে মতাদর্শগত যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url