ভারতের দলীয় ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য প্রধান দু'টি রাজনৈতিক দলের নীতি, মতাদর্শ ও কর্মসূচি
ভারতের দলীয় ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করতে পারবেন;
ভারতের প্রধান দু'টি রাজনৈতিক দলের নীতি, মতাদর্শ ও কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে পারবেন।
ভূমিকা
রাজনৈতিক দল ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর্নেষ্ট বার্কার (Earnest Barker)-এর মতে, আমরা যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ফলপ্রসু ব্যবস্থারূপে গণ্য করি, তাহলে দলীয় ব্যবস্থাকেও আমাদের স্বীকার করতে হবে। VO Key বলেছেন, রাজনৈতিক দল গণতান্ত্রিক পদ্ধতির একটি মৌলিক উপাদানে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ভারতে রাজনৈতিক দল সে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতের দলীয় ব্যবস্থা বৈচিত্র্যপূর্ণ। দলগুলোর সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তি, সাংগঠনিক কাঠামো, কর্মসূচী এবং কার্য পরিচালনার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। এখন আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ভারতের দলীয় ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য
ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। নিম্নে ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলোঃ
রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক স্বীকৃতি নেইঃ ভারতের সংবিধানে রাজনৈতিক দলের বিষয়ে উল্লেখ নেই। কোন আইনের মাধ্যমে এর উদ্ভব হয় নি। গণতান্ত্রিক ভাবধারা বিকশের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবেই রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয়েছে।
বহুদলীয় ব্যবস্থাঃ ভারতীয় দলীয় ব্যবস্থার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, এখানে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, জাতীয় দল ছাড়াও অনেক আঞ্চলিক এবং অন্যান্য রেজিস্ট্রিকৃত দল আছে।
শক্তিশালী ও সংগঠিত একাধিক বিরোধীদলের অনুপস্থিতি: অদ্যাবধি কংগ্রেস (আই) এবং বিজেপি ছাড়া কোন দল তাদের অবস্থানকে শক্তিশালী বিরোধী অবস্থানে পরিণত করতে পারেনি।
দলীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তির প্রাধান্য: জওহর লাল নেহেরুর কংগ্রেসে একচ্ছত্র প্রধান্য ছিল। পরবর্তীতে ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী এবং একই সূত্র ধরে নরসীমা রাও এ ধারা অক্ষুন্ন রেখে ছিলেন। বিজেপি-তে লালকৃষ্ণ আদভানী, অটলবিহারী বাজপেয়ী, জনতা দলের ভি. পি. সিং দলীয় ব্যবস্থায় ব্যক্তির প্রাধান্য রেখেছেন।
জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায় ও ভাষাভিত্তিক দল: শিবসেনা, হিন্দু মহাসভা, ইত্তেহাদুল মুসলেমিন, মুসলিম লীগ, বিজেপি প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দল। ডি, এম, কে এবং এ আই. ডি. এম. ইত্যাদি জাত-পাত (ধর্ম ও) ভাষাভিত্তিক দল। তফসিলী জাতিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য শোষিত দল, বহুজন সমাজ পার্টি, রিপাবলিকান পার্টি গঠিত হয়েছে। এভাবে ভারতে জাত-পাত, উপজাতি, ধর্ম ও ভাষাভিত্তিক দল গঠিত হয়েছে।
ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলের প্রধান্যঃ ভারতের রাজনীতিতে আঞ্চলিক দলের সাথে নির্বাচনী জোট ও সরকার গঠনে উৎসাহ প্রদান করায় আঞ্চলিক দলকে বৃহত্তর জাতীয় জোটের অংশীদারে পরিণত করা হয়েছে। এর ফলে রাজনীতিতে আঞ্চলিকতা প্রাধান্য পেয়েছে।
মতাদর্শগত পার্থক্য: ভারতের দলীয় ব্যবস্থার একটা চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শগত ভিত্তি। এখানে চরম বামপন্থী থেকে চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দল আছে। আছে মধ্যপন্থী সুবিধাবাদী দল। কোন দল আমূল পরিবর্তনের জন্য বৈপ্লবিক মতাদর্শের প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। আবার কোন দল আর্থ-সামাজিক স্থিতাবস্থার পক্ষে।
রাজনৈতিক দলের ভাঙনঃ দলীয় ব্যবস্থার অন্তর্দলীয় কোন্দলের ফলে বিভিন্ন দলের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা গেছে।
প্রাধান্যকারী দলীয় ব্যবস্থা: অনেকের মতে, ভারতের দলীয় ব্যবস্থা প্রাধান্যকারী দলীয় ব্যবস্থা (Dominant Party System) প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানে কংগ্রেস তার প্রাধান্য বজায় রেখেছে। বর্তমানে বি. জে. পি. ক্ষমতায় আসায় অবশ্য এ প্রাধান্য কিছুটা খর্ব হয়েছে।
এককেন্দ্রিক প্রবণতা: এখানে দলীয় কাঠামো এককেন্দ্রিক প্রবণতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। দলের রাজ্য ও আঞ্চলিক শাখা থেকে শুরু করে প্রতিটি সাংগঠনিক স্তরই দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশ ও নেতৃত্বের যারা পরিচালিত।
স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর সাথে যোগ: ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী (Interest group)-এর সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলে।
দলত্যাগ: দলত্যাগ ভারতের দলীয় ব্যবস্থায় একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। বামপন্থী দল ব্যতীত অন্যান্য দল থেকে ব্যাপকহারে সদস্যগণ দলত্যাগ করেছেন।
দলীয় সংহতির অভাব ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বঃ বিভিন্ন দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্য, সংহতি এবং শৃংখলার অভাব ভারতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার আরো একটি বৈশিষ্ট্য।
জোটবদ্ধ সরকার ও রাজনীতি: ১৯৬৭ এর পর থেকে এ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। জোটবদ্ধ রাজনীতি এবং বিভিন্ন সময়ে জোটবদ্ধ সরকার (Coalition Government) গঠিত হয়েছে।
ভারতের রাজনৈতিক দল
ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বহু দলের কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়। এ দলগুলোকে আঞ্চলিক ও জাতীয় দলে ভাগ করা যায়। জাতীয় দলের মধ্যে কংগ্রেস (আই), কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), বি. জে. পি., জনতাদল, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি দল রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, এখানে প্রধান দু'টি রাজনৈতিক দল নিয়ে আমরা আলোচনা করব।
কংগ্রেস (আই)
ব্রিটিশ আমলে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস গঠিত হয়। পরবর্তীতে এ দলটি স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনকারীদের প্লাটফর্ম-এ পরিণত হয়। কংগ্রস (আই) স্বাধীনতার পর ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এককভাবে সাফল্য অর্জন করেছে এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় থেকেছে। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস রাজ্যসভা ও লোকসভায় ব্যাপক পরাজয়ের ফলে সরকারী ক্ষমতায় হারায়। ১৯৬৯ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে কংগ্রেস দলের প্রধান নেতাদের বিরোধের ফলে কংগ্রেস দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস (শাসক) ও বিরোধীদের কংগ্রেস (সংগঠন)। ১৯৭৮ সালে ইন্দিরা গান্ধীকে সভানেত্রী করে গঠিত হয় কংগ্রেস (আই)। ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে কংগ্রেস (আই) দলকে নির্বাচন কমিশন ভারতের সরকার গঠনে সক্ষম হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধী এর হাল ধরেন। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পর নরসীমা রাও এবং তারপর সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস (আই) গঠিত হয়েছে।
কংগ্রেস (আই) দলের সাংগঠনিক কাঠামো ক্রমস্তর বিন্যস্ত। সর্বনিম্ন সাংগঠনিক স্তর হল ব্লক কংগ্রেস। এর উপরে আছে যথাক্রমে জেলা কংগ্রেস এবং প্রদেশ কংগ্রেস। সর্ব ভারতীয় স্তরে আছে সর্ব ভারতীয় কংগ্রেস কমিটি (AIC.S.) দলের সর্বোচ্চ পদাধিকারী হলেন সভাপতি। সাংগঠনিক দিক থেকে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিই হলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ সংস্থা। তবে কার্যক্ষেত্রে দলীয় নেতাই সর্বেসর্বা।
মতাদর্শগত দিক থেকে পরস্পর বিরোধী রাজনৈতিক মতাবলম্বী নেতাদের মঞ্চ ছিল। এককভাবে বামপন্থী বা চরমপন্থী নীতি গ্রহণ না করে সর্বদা সংস্কারবাদী দৃষ্টি বজায় রেখেছে। ১৯৪৮ সালে জয়পুরে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের ৫৫তম অধিবেশনে ঘোষণা করা হয় কংগ্রেস এমনভাবে দেশ গড়তে ইচ্ছুক যেখানে ধর্ম, বর্ণ, জাতিগত বৈষম্য দূর করে সকল ভারতবাসীর জন্য সমান অধিকার এবং সুযোগ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। বর্তমানেও কংগ্রেস (আই) সেই আদর্শকে সামনে রেখেছে।
বি. জে. পি. (ভারতীয় জনতা পার্টি)
১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর জনতা পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা প্রাক্তন জনসংখী নিয়ে এ দল গঠিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে একে পুরানো জনসংঘের নতুন সংস্করণ বলা যায়। এ দলটি হিন্দু মৌলবাদী রক্ষণশীল দল। সাম্প্রদায়িকতাকে উপজীব্য করে বি.জে.পি-র রাজনীতি প্রকৃতপক্ষে 'রাম রাজনীতি' তে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ দলটি মূলনীতি হিসাবে বলেছে-জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় ঐক্য। গান্ধীবাদী সমাজতন্ত্র, মূল্যবোধ ভিত্তিক রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাসী এ দল বর্তমান গণতান্ত্রিক কাঠামোর সমর্থক। কৃষি কাঠামোর পুনবিন্যাস, ব্যক্তি মালিকানার অধিকার অব্যাহত রাখা, দারিদ্র দূরীকরণ, গ্রামাঞ্চলে পানীয় জল সরবরাহ, দরিদ্রদের জন্য স্বল্পমূল্যে গৃহ নির্মাণ পরিকল্পনার ব্যবস্থা, পরিবার পরিকল্পনা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, প্রকৃত গোষ্ঠী নিরপেক্ষতা ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি বি. জে. পি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসাবে নির্ধারণ করেছে।
সারকথা
ভারতে রাজনৈতিক দলের সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকলেও সে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রধান ভূমিকা রাখছে। বহু দলীয় এ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন-ব্যক্তি প্রাধান্য, সাম্প্রদায়িক দল, আঞ্চলিক প্রাধান্য, দলগুলোর ভাঙন, সংহতির অভাব, মতাদর্শগত পার্থক্য, জোটবদ্ধতা ইত্যাদি। প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস (বর্তমানে কংগ্রেস-আই) প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভারতের রাজনীতিতে সবসময় প্রাধান্য বিস্তার করেছে। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বি. জে পি তাদের সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী নীতি নিয়ে দেশের রাজনীতিতে বেশ ভাল স্থানে অবস্থান করছে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url