মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী

মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার উৎস বর্ণনা ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট এর ক্ষমতা ও কার্যাবলী ব্যাখ্যা করতে পারবেন।

ভূমিকা

মার্কিন শাসনব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টের পদটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সাংবিধানিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেক ক্ষমতার অধিকারী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট, আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্র প্রধান ও শাসন বিভাগের প্রকৃত কর্ণধার। তিনি ব্রিটেনের রাজার মত রাজত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর মত শাসন করেন। এ প্রসঙ্গে Brogan বলেন, "He is the formal head of the nation He is also the effective head of the executive" মার্কিন সংবিধান প্রণেতাগণ তাঁকে একজন শক্তিশালী ও মর্যাদাবান ব্যক্তি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেছেন। বিগত ঘটনা প্রবাহে রাষ্ট্রপতির হাতে বহু ও বিভিন্ন প্রকারের ক্ষমতা পুঞ্জিভূত রয়েছে।

আরো পড়ুন: ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার উৎস

মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সাধারণ নিয়মে আসে নি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার পিছনে কতিপয় উৎস রয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার উৎসগুলোকে নিম্নে উল্লেখ করা হল:

সংবিধান: মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সাংবিধানিক উপায়ে স্বীকৃত। সংবিধান হল তাঁর ক্ষমতার প্রধান উৎস। সংবিধানের মাধ্যমে তাঁর যাবতীয় কার্যাবলী নির্ধারিত ও পরিচলিত। সংবিধানে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার পরিধি স্থির করে নেয়া আছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতির বহুবিধ ক্ষমতার প্রধান উৎস হল সংবিধান।

কংগ্রেস: কংগ্রেস হল আমেরিকার রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অন্যতম প্রধান উৎস। তাঁর ক্ষমতা যে শুধু সাংবিধানিক উপায়ে নির্ধারণ করা হয়েছে তা নয়। মার্কিন কংগ্রেসের বিভিন্ন আইনের দ্বারা এ ক্ষমতা নির্ধারিত হয়েছে। তাঁর নিয়োগ ক্ষমতা, আদেশ বা নির্দেশ জারীর ক্ষমতা প্রভৃতিতে কংগ্রেসের অনুমোদন আবশ্যক। এছাড়া কংগ্রেসের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের বেতন, আয়-ব্যয় নির্ধারিত হয়।

সুপ্রীম কোট: সুপ্রীম কোর্ট মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার একটি বিশেষ উৎস। সংবিধান সংক্রান্ত ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টের ব্যাখ্যা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সম্প্রসারণ করেছে। রাষ্ট্রপতি সুপ্রীম কোর্টের ব্যাখ্যায় কিছু কিছু ক্ষমতা ভোগ করেন। এ ক্ষেত্রে একটি মামলা উল্লেখ করা যায়। মেয়ার্স বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯২৬ Myers Vs United states 1926 মামলায় সুপ্রীম কোট এই মর্মে রায় দেয় যে, রাষ্ট্রপতি এককভাবে সরকারী কর্মচারীদের পদচ্যুত করতে পারেন।

প্রথা ও রীতিনীতি: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর ন্যায় প্রথা ভিত্তিক কিছু ক্ষমতা ভোগ করেন। মার্কিন শাসনব্যবস্থায় বহু অলিখিত বিষয় আছে। এগুলো প্রথা ও রীতি দ্বারা নির্ধারিত যা মার্কিন শাসন ব্যবস্থায় উল্লেখ নেই।

রাষ্ট্রপতির ভূমিকা: পূর্বে ক্ষমতাসীন অন্যান্য রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রাষ্ট্র মার্কিন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার আরেকটি উৎস। শাসন ব্যবস্থায় বিভিন্ন রাষ্ট্রপতিদের গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সম্প্রসারিত করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের অসামান্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাষ্ট্রপতিদের উদ্যোগী ও সক্রিয় ভূমিকা পরবর্তী রাষ্ট্রপতিদের ক্ষমতার উৎস হিসেবে কাজ করে আসছে। এক্ষেত্রে স্বনামধন্য রাষ্ট্রপতি আব্রাহাম লিংকন, উড্র উইলসন, ফ্রাং লিন ও রুজভেল্ট, রোনাল্ড রিগান, বিল ক্লিনটন এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্যা।

আরো পড়ুন: ভারতের বিচার ব্যবস্থা সুপ্রীমকোর্টের গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী

মার্কিন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী

১. শাসন ক্ষমতা: মার্কিন রাষ্ট্রপতি শাসন বিভাগীয় প্রধান। শাসন সংক্রান্ত যাবতীয় ক্ষমতা তাঁকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। সংবিধান মার্কিন প্রেসিডেন্টকে শাসন বিষয়ে প্রভুত ক্ষমতা দিয়েছে। তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনের জন্য বিভিন্ন দপ্তর প্রধান ও অধঃস্তন কর্মাচারীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। সংবিধানের (১) নং ধারা অনুসারে মার্কিন রাষ্ট্রপতি এই ক্ষমতা ভোগ করেন। শাসক প্রধান হিসেবে রাষ্ট্রীয় পদে নিয়োগদানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। রাষ্ট্রপতি সিনেটের পরামর্শক্রমে ক্যাবিনেট সদস্য, সুপ্রীম কোর্টের বিচার ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে নিয়োগ করেন। তিনি দোষী সাব্যস্ত করে কর্মকর্তাদের অপসারণ করতে পারেন। তিনি নির্বাহী আদেশ Executive orders) জারী করার ক্ষমতা রাখেন। তিনি দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী দমন, শান্তি শৃংখলা রক্ষা ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পাবেন।

২. আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা: আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি বিশেষ ক্ষমতা। আইন সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বহুবিধ ক্ষমতা ভোগ করেন। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফাইনার বলেন, "American president has become a very active legislative leader as well as an executive" সংবিধানের ২নং ধারা অনুসারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দেশের অবস্থা সম্পর্কে কংগ্রেসে বাণী পাঠাতে পারেন। তিনি কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন ডাকার ক্ষমতা রাখেন। রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া কোন বিল আইনে পরিণত হয় না। সংবিধান সংশোধনী বিল ছাড়া অন্যান্য বিলে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন প্রয়োজন। তিনি কোন বিল অনুমোদনে অস্বীকৃতি জানাতে পারেন কিংবা আটকেও রাখতে পারেন। তিনি কংগ্রেস প্রণীত আইনের ফাঁকগুলো পূরণের জন্য শাসন বিভাগীয় আদেশ, অডিন্যান্স জারী করতে পারেন। তাঁর এ আদেশ আইনের ন্যায় কার্যকরী। প্রেসিডেন্ট সরকারী নীতি প্রণয়নে অনুপ্রেরণা ও নির্দেশ দিয়ে থাকেন।

৩. বিচার বিভাগীয় কার্যাবলী: মার্কিন রাষ্ট্রপতি শাসন ও আইন বিষয়ের ন্যায় কতিপয় বিচার সংক্রান্ত কাজ সম্পন্ন করেন। তিনি কোন দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির দন্ডাদেশ হ্রাস কিংবা মওকুফ করতে পারেন। তিনি সুপ্রীম কোর্টে বিচারকদের নিয়োগ করেন। কিন্তু তাঁদের তিনি ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেন না। ফৌজদারী মামলায় দন্ডিত অপরাধীকেও রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন। তিনি ক্ষমা প্রদর্শন করলে তা বাধ্যতামূলক হয়। নাগরিকদের ভোটাধিকার বা সরকারী চাকরীলাভের সমানাধিকার রক্ষায় প্রেসিডেন্ট কেন্দ্রীয় আদালতে মামলার সূচনা করতে পারেন। সংবিধান ও আইন ব্যাখ্যার সুযোগও তাঁর রয়েছে।

৪. দলীয় নেতা হিসেবে কাজ: মার্কিন প্রেসিডেন্ট দলের নেতা। দলীয় নেতা হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দলীয় নেতৃত্বের কারণে দলের চাবিকাঠি তাঁর হাতেই। এ সুবাধে তিনি দল এবং কংগ্রেসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। মার্কিন শাসন ব্যবস্থা দলভিত্তিক। রাষ্ট্রপতির মর্যাদা দলের সাফল্যের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। তিনি পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কংগ্রেসে স্বদলের সদস্যদের প্রভাবিত করেন। দলের স্বার্থের সঙ্গে তার স্বার্থ জড়িত। গুরুত্বপূর্ণ পদসহ তিনি দলের জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যানকে নিযুক্ত করেন।

৫ কুটনৈতিক ক্ষমতা: কুটনৈতিক ক্ষমতা মার্কিন প্রেসিডেন্টের একটি বিশেষ ক্ষমতা। তিনি তাঁর দেশের পক্ষে পররাষ্ট্র বিষয়ক ভূমিকায় উত্তীর্ণ হন। পররাষ্ট্র বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা তিনি প্রয়োগ করেন। তিনি রাষ্ট্রদূতদের নিয়োগ করেন। এক্ষেত্রে তিনি সিনেটের সাথে পরামর্শ করে থাকেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বৈদেশিক চুক্তি সম্পর্কিত কাজ পরিচালনা করেন। অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে নির্বাহী চুক্তি (Executive Agreement) সম্পাদন করেন। বৈদেশিক কুটনীতি গ্রহণ এবং বিদেশে কুটনীতিক প্রেরণের ক্ষমতা তাঁর হাতে ন্যাস্ত। এ ছাড়া তিনি বিদেশী সরকারকে স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি জানাতে পারেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তিনি নিজ দেশের সরকারী মুখপাত্রও বটে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি হলেন পররাষ্ট্র বিষয়ে জাতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

৬. অর্থ সংক্রান্ত কাজ : মার্কিন প্রেসিডেন্ট কতিপয় অর্থ সংক্রান্ত দায়িত্বও পালন করেন। এ ব্যাপারে তিনি ব্যাপক ক্ষমতা ভোগ করেন। তিনি সারা বছরের জন্য আনুমানিক আয়-ব্যয়ের একটি প্রস্তাব কংগ্রেসে প্রেরণ করেন। তিনি পরিপূরক ব্যয় বরাদ্দের দাবীও পেশ করতে পারেন। তাঁর দলের সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে কংগ্রেস এ প্রস্তাব নাকচ হয় না। এ বিষয়ে তাকে সহযোগিতা করার জন্য একটি বাজেট ব্যুরো (Budget Bureau) রয়েছে। এ ব্যুরোর প্রধান ডাইরেক্টর রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হন। রাষ্ট্রপতি এ ক্ষমতা বলে বিভিন্ন বিভাগের ব্যয় হ্রাস, বৃদ্ধি বা সংশোধন করতে পারেন।

৭. বিশ্ব নেতা হিসেবে ভূমিকা: মার্কিন প্রেসিডেন্ট বর্তমান বিশ্বের এক বিশিষ্ট নেতা। বিশ্ব রাজনীতির পরিমন্ডলে তার ভূমিকা অপরিসীম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে তিনি বিশ্ব ব্যবস্থায় মার্কিন নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের চেষ্টা করেন। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় তার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাঁর ভূমিকার প্রভাব অন্যান্য রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়। বর্তমান তাঁর সামরিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক নেতৃত্ব বিশ্বের একটি প্রধান শক্তিরূপে কাজ করছে। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তাঁর এ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর থেকে পুঁজিবাদী নেতা হিসেবে তাঁর প্রভাব ও ভূমিকা অপরিসীম।

সারকথা

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হলেন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রেসিডেন্ট। এ শাসন ব্যবস্থায় আইনত ও বাস্তব ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে ন্যস্তে। তিনি মার্কিন শাসন বিভাগের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁর ক্ষমতার মূল উৎস হল সংবিধান। সাংবিধানিকভাবে তিনি তাঁর যাবতীয় ক্ষমতা ও কার্যাবলী পালন করে। তিনি প্রকৃত পক্ষে মার্কিন কংগ্রেসের নেতা। তিনি তাঁর দলের নেতা। জাতীয় ও আন্তজার্তিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url