ভারতের শাসন বিভাগ
ভারতের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, কার্যাবলী ও সাংবিধানিক অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করতে পারবেন;
ভারতের মন্ত্রীসভার গঠন, ক্ষমতা, কার্যাবলী ও মন্ত্রীদের যৌথ দায়িত্বশীলতা ব্যাখ্যা করতে পারবেন;
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, কার্যাবলী ও সাংবিধানিক স্থান ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
ভূমিকাঃ
ভারতের সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্যে সংসদীয় সরকার বা মন্ত্রীসভা পরিচালিত সরকার ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রীপরিষদ নিয়ে কেন্দ্রের শাসন বিভাগের রাজনৈতিক অংশ গঠিত। শাসন বিভাগের অরাজনৈতিক অংশ হচ্ছে প্রশাসন বা আমলাতন্ত্র। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান। উপ-রাষ্ট্রপতি পদাধিকার বলে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান। সমমর্যাদা সম্পন্ন মন্ত্রীদের গঠিত মন্ত্রীপরিষদই রাষ্ট্রপতির নামে কেন্দ্রের শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও কার্যাবলী পরিচালনা করে। প্রকৃতিগত দিক থেকে কেন্দ্রের শাসন বিভাগ বহু ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত। কিন্তু সাম্প্রতিককালে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এবং প্রভাব এতদূর বর্ধিত হয়েছে যে, অনেক সমালোচক ভারতকে 'প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার' নামে অভিহিত করেন।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, কার্যাবলী ও সাংবিধানিক স্থান
ভারতের সংবিধানে আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রের শাসন বিভাগের প্রধান। বাস্তবে তিনি হলেন নাম সর্বস্ব (Titular) বা নিয়মতান্ত্রিক প্রধান (Constitutional Head)। ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধন অনুযায়ী তিনি মন্ত্রি পরিষদের সাহায্য এবং পরামর্শ অনুযায়ী কার্যপরিচালনা করতে বাধ্য। রাষ্ট্রপতি তার নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতীত কার্যাবলী পরিচালনা করতে পারেন না।
শাসন বিভাগ সংক্রান্ত ক্ষমতা
রাষ্ট্রপতি কেন্দ্রের শাসন বিভাগের সর্বোচ্চ পদাধিকারী এবং শাসন বিভাগের সকল ক্ষমতা তার হাতে ন্যস্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন বিভাগীয় কার্যাবলী রাষ্ট্রপতির নামে পরিচালিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ ও অপসারণ, সশস্ত্র বাহিনীর পরিচালনা ইত্যাদি ক্ষমতা তিনি ভোগ করেন।
আইন সম্পর্কিত ক্ষমতা
সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্য মনোনয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এছাড়া তিনি অধিবেশন আহবান, বিলে সম্মতি দান, অর্ডিন্যান্স জারী, সদস্যপদের যোগ্যতা নির্ধারণ করেন। ৮৬ (১) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি যে কোন কক্ষে অথবা উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিতে পারেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি সদস্যদের উপস্থিতির জন্য নির্দেশ দিতে পারেন।
আর্থিক বিষয়াদি সংক্রান্ত ক্ষমতা
১১২ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পরবর্তী বছরের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের আয়-ব্যয় বরাদ্দের আনুমানিক হিসেব সংসদে পেশ করার ব্যবস্থা করেন। তিনি অনুপূরক বাজেটও পেশ করতে পারেন। এছাড়া তিনি জরুরি তহবিল নিয়ন্ত্রণ করেন।
বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা
রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার, বিশেষভাবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পরামর্শ অনুযায়ী এ ক্ষমতা প্রয়োগ করেন।
জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা
সংবিধানের অষ্টাদশ অংশে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। জরুরি অবস্থা বলতে যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ ও সশস্ত্র বিদ্রোহজনিত আপদকালীন অবস্থা, রাজ্যে সাংবিধানিক অচলাবস্থা, এবং আর্থিক জরুরি অবস্থাকে নির্দেশ করে।
অন্যান্য ক্ষমতা
এছাড়া রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগ, ভাতার অগ্রগতি বিষয়ক পর্যালোচনা, জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসন সংক্রান্ত বিশেষ ক্ষমতা, বিশেষ বিশেষ রাজ্যে ক্ষমতা প্রয়োগ এবং রাজ্যপাল নিয়োগ, আইনের কোন বিষয়কে কার্যকর করার বাধা অপসারণের জন্য রাষ্ট্রপতি আদেশ জারী করতে পারেন।
ভারতের মন্ত্রীসভার গঠন, ক্ষমতা ও কার্যাবলী
সংসদীয় গণতন্ত্রে শাসন বিভাগের দ্বৈত ব্যক্তিত্ব পাশাপশি বিদ্যমান। একদিকে অলঙ্কারিক প্রধান এবং অন্যদিকে শাসন বিভাগের প্রকৃত বা কার্যকরী সত্ত্বা। ভারতীয় শাসন ব্যবস্থায় প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীপরিষদ সরকারের সকল ক্ষমতা প্রয়োগ এবং দায়িত্ব পালন করেন।
মন্ত্রীপরিষদ কিভাবে কোন পদ্ধতিতে গঠিত হবে তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ সংবিধানে নেই। কেবল উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে নিয়োগ করেন এবং প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়োগ করেন। মন্ত্রীদের সংখ্যা সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই। সাধারণতঃ লোক সভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকারী দল মন্ত্রীপরিষদ গঠন করে এবং ঐ দলের নেতা বা নেত্রীকে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে তিনি অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগ করেন। মন্ত্রীপরিষদের আয়তন, গঠন, পুনর্গঠন, দপ্তর বন্টন এবং মন্ত্রীদের অপসারণ প্রধানমন্ত্রী ও শাসকদলের উপর নির্ভর করে।
সংবিধানের ২টি ধারা ৭৪ এবং ৭৫ ধারায় মন্ত্রীপরিষদের কার্যাবলী সম্পর্কে সংক্ষেপে উল্লেখ আছে। রাষ্ট্রপতির কার্য পরিচালনায় সাহায্য এবং পরামর্শ দান করা এদের দায়িত্ব। মন্ত্রীপরিষদের কোন প্রস্তাব রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গৃহীত না হলে রাষ্ট্রপতি তা পুনর্বিবেচনার জন্য ফেরত পাঠাতে পারেন কিন্তু দ্বিতীয়বার যদি সেই প্রস্তাব সংশোধিত বা অসংশোধিত অবস্থায় সম্মতির জন্য পাঠায় তবে রাষ্ট্রপতি সম্মতি প্রদান করতে বাধ্য। উপরন্ত, মন্ত্রীপরিষদের বৈধতা সম্পর্কে বা পরামর্শের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন করা যায় না। এছাড়া মন্ত্রীপরিষদ যে সমস্ত কার্যাবলী সম্পন্ন করে তা হলো সরকারী নীতি প্রণয়ন, আইন প্রণয়নে উদ্যোগ নেয়া, বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয় সাধন, আর্থিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ইত্যাদি।
দায়িত্বশীলতা
বিভিন্ন দপ্তরের বিষয় সম্পর্কে মন্ত্রীপরিষদ কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী আইনসভায় পেশ করেন। সুতরাং মন্ত্রীর সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবার অর্থ আইনসভা কর্তৃক মন্ত্রীসভার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। অর্থাৎ মন্ত্রীসভা যৌথভাবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখে বা অপসারিত হয়।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, কার্যাবলী ও সাংবিধানিক অবস্থান
ভারতের শাসন ব্যবস্থা এবং রাজনীতিতে সর্বাপেক্ষা গুরূত্বপূর্ণ হলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি কেবল কেন্দ্রীয় সরকারেরই নন, সমগ্র দেশের প্রশাসনিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক কেন্দ্রীয় চরিত্র। সরকারী কাঠামোর ঐতিহ্য ও রীতি-নীতি অনুসারে প্রধানমন্ত্রীই শাসন-বিভাগের প্রকৃত প্রধান। তাঁকে কেন্দ্র করেই কেন্দ্রীয় সরকারের কার্যাবলী, নীতি-নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার রূপায়ন আবর্তিত হয়। সাম্প্রতিককালে ভারতের সংসদীয় কাঠামোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা এবং প্রভাবের মাধ্যমে নিজের পদমর্যাদাকে যেভাবে অলঙ্কৃত এবং সংহত করেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংসদীয় গণতন্ত্র গ্রহণ করেছে এমন কোন দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেই এত ব্যাপক ক্ষমতা প্রয়োগ এবং প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হয় নি। প্রধানমন্ত্রী কেবল 'সমকক্ষদের মধ্যে প্রধান'- এর ভূমিকায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি, তিনি নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং প্রতিরোধহীন নেতা/নেত্রীতে পরিণত করেছেন। কাঠামোগত দিক থেকে সংসদীয় ব্যবস্থা থাকলেও, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাঠামো প্রধানমন্ত্রী শাসিত (Prime Ministerial form of Government) ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। কোন কোন বিশ্লেষকের মতে, প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা পরিচালনার পদ্ধতি প্রধানমন্ত্রীকে মার্কিন রাষ্ট্রপতির সমপর্যায়ে উন্নীত করেছে। এ অবস্থাকে 'প্রধানমন্ত্রী পদের রাষ্ট্রপতিকরণ' (Presidentialisation of the Prime Minister) নামে অভিহিত করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী সম্পর্কে সংবিধানে বিস্তৃত কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন তা' সংবিধান নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে আবন্ধ থাকে না। তার কার্যাবলীর কিছু অংশ সংবিধানে উল্লেখ আছে, বাকী অংশ সাংবিধানিক রীতি-নীতি ও প্রচলিত প্রথার উপর নির্ভরশীল। তিনি যে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন, তা' মন্ত্রীপরিষদের প্রধান হিসেবেই প্রয়োগ করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যাবলীর দু'টি দিক থেকে বিচার করা যায়। সরকার প্রধান হিসাবে প্রধানমন্ত্রী এবং দলের নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রী।
সরকার প্রধান হিসাবে
- প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীপরিষদ গঠন, মন্ত্রীদের দপ্তর পরিবর্তন, কোন মন্ত্রীর পদত্যাগ, অপসারণ, বিভিন্ন কাজের সমন্বয় সাধন এবং সরকারী নীতি প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে মূখ্য উদ্যোগ নেন।
- কোন কোন মন্ত্রীকে নিয়ে ক্যাবিনেট গঠিত হবে, সংখ্যা কত হবে প্রধানমন্ত্রী তা স্থির করেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন ছাড়া কোন বিষয় ক্যাবিনেটের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।
- রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রীপরিষদের মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে প্রধানমন্ত্রী কাজ করেন।
- রাষ্ট্রপতির সাথে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্ক শুধু আইনের সীমানার মধ্যেই থাকে না। তাঁদের রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপরেও নির্ভরশীল।
- সরকার প্রধান হিসাবে দেশে এবং বিদেশে প্রধানমন্ত্রী ভারতের বৈদেশিক নীতির প্রধান রূপকার এবং মূখ্য প্রবক্তা।
- প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির প্রধান পরামর্শদাতা।
- সংসদীয় দলের নেতা, অধিবেশন আহবান এবং সমাপ্তি ঘোষণা করা এবং লোকসভা ভেঙ্গে দেবার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা মূখ্য।
- অন্যান্য কাজের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নীতি নির্ধারণী কাজ প্রধান।
দলের নেতা হিসাবে:
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সরকার পরিচালনা, দলীয় কর্মসূচীর সার্থক রূপায়ন, সরকারের ঘোষিত কর্মসূচীর জনপ্রিয়তা এবং সর্বাপেক্ষা জনমানসে সরকার সম্পর্কে তিনি কি ভাবমূর্তি উপস্থাপন করেছেন, তার উপর শাসকদলের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল।
সারকথা
ভারতে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। তাঁর নামে শাসনবিভাগীয় কার্যাবলী পরিচালিত হয় এবং তিনি তাঁর নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করেন। লোকসভায় নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল মন্ত্রীপরিষদ গঠন করে এবং ঐ দলের নেতা/নেত্রী প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন। মন্ত্রীপরিষদ রাষ্ট্রপতিকে কার্য পরিচালনার সাহায্য এবং পরামর্শ দান ছাড়াও কিছু নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করে। প্রধানমন্ত্রী শাসন-বিভাগের প্রকৃত প্রধান। বর্তমানে তার ক্ষমতা ও প্রভাবের কারণে অনেকে ভারতের শাসন ব্যবস্থাকে 'প্রধানমন্ত্রী শাসিত' বলে অভিহিত করেন।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url